ঢাকাঃ

নির্যাতনের কারণে ৫ বছরে ৩০ ছাত্র বুয়েট ছেড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পর্যন্ত ওইসব শিক্ষার্থীরা বুয়েট ছাড়তে বাধ্য হন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে আমাদের সময়।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, বুয়েট ছাড়া অধিকাংশ ছাত্রকেই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নির্যাতন করা হয়। এর আগেও নির্যাতনের শিকার হয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বুয়েট ত্যাগ করেন। 

শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ জানাতে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা একটি ওয়েবপেজ চালু করে। এ ওয়েবপেজে গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত জমা পড়েছে ১৬৬টি অভিযোগ। ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ খোলা পেজটি গতকাল ১০ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বন্ধ করে দিয়েছে।

নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৭ সালে বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলে তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী আসাদ রহমানকে ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতন করা হয়। পরের বছর তিনি বুয়েট ছেড়ে একটি পাবলিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। একই বছরে আবদুর রহিম নামে আরো এক শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয়ে বুয়েট ছেড়ে সিলেট এমজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে দুজনই কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি তারা।

নির্যাতিত আবদুর রহিম বলেন, ‘আমার স্বপ্নই শেষ হয়ে গিয়েছে। এখনো বুয়েটের দিনগুলো ভুলতে পারছি না। আবরারের ঘটনার পর তো মনে হচ্ছে, জীবন নিয়ে যে ফিরতে পেরেছি, সেটাই ভাগ্য।’

গত বছর মারধরের শিকার হয়ে বুয়েট ত্যাগ করতে বাধ্য হন নজরুল ইসলাম হলের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ।

বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামী উস সানি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যারাই এমন র‌্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই। অপরাধীর পরিচয় অপরাধী, তার পরিচয় ছাত্রলীগ না।’

বুয়েটের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একেএম মাসুদ বলেন, ‘ক্ষমতাসীন ছাত্ররা প্রভাব বিস্তার করতে র‌্যাগের নামে নির্যাতন করছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশাসন বরাবরই নিশ্চুপ।’ আবরারের খুনের দায় প্রশাসন এড়িয়ে যেতে পারে না বলেও মনে করেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি হলেই তারা নিয়মিত র‌্যাগিংয়ের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বৃহস্পতি এবং শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয় সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় প্রতি সপ্তাহে বুধ এবং বৃহস্পতিবার গেস্টরুমে রাজনৈতিক হাজিরা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের। সেদিনই অনেকে র‌্যাগিংয়ের শিকার হন। 

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, বুয়েটের ৮ হলের প্রতিটিতে কমপক্ষে ৫টি করে রাজনৈতিক কক্ষ আছে, যেখানে ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের ডেকে মারধর ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন চালানো হয়। হলের ছাদেও চলে এই ধরনের নির্যাতন। এ ধরনের নির্যাতন করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সবাই জানলেও কেউই প্রতিবাদ করত না।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে শেরেবাংলা হলের ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রুবেল নামে এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়। গত বছরের ৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী হলের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দাইয়্যান নাফিজকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি খন্দকার জামী-উস সানির নেতৃত্বে মারধর করা হয়। সে সময়ে ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ওই শিক্ষার্থীকে ফেসবুক লাইভে এনে গুজব সৃষ্টি করেছেন এ মর্মে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেন।

২০১৫ সালে রাব্বানীর নেতৃত্বে বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী শাহাদাৎ হোসেইনকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। চলতি বছরের ২৭ জুন আহসানউল্লাহ হলে ২০৫ নম্বর রুমে তিনজনকে মারধর করার প্রতিবাদ জানান অভিজিৎ কর নামে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী। এ কারণে তাকেও নির্যাতন করা হয়। চড়ের কারণে এক কানে আর শুনতে পাননা অভিজিৎ।

২০১৩ সালে এনামুল হক নামে এক শিক্ষার্থীকে মেকানিক্যাল কুইজ পরীক্ষার দেওয়ার সময় হল থেকে তুলে এনে আহসানউল্লাহ হলের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিত ৩১৯ নম্বর রুমে মারধর করা হয়।

অভিযোগ দেয়ার ওয়েবপেজ ঘেঁটে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। ড. এমএ রশিদ হলে এক ছাত্রের কানে গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়। ২০১৫ সালে বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি শুভ্র জ্যোতি টিকাদার এক ছাত্রকে মারধর করেন। তার মুখে লাথি মেরে রক্তাক্ত করার পর আরেক ছাত্রলীগ নেতা ক্ষত স্থানে লবণ ছিটিয়ে দেন। র‌্যাগিংয়ের নামে এক শিক্ষার্থীকে পেটানোর কারণে তার কান ফেটে যায়।

এ অভিযোগের সত্যতা মেলায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে হল থেকে বহিষ্কার করা হয় আহসানউল্লাহ হলের ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র লাহিড়ী। কিন্তু দলীয় প্রভাবের জোর দেখিয়ে হল ছাড়েন নি তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here