ঝিনাইদহে টিসিবি’র ডিলার নবায়নে ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতিবাজ ৯ জন কর্মকর্তা আবারো টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীদের নামে লাইসেন্স বহাল রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিকবার তদন্ত করে তালিকা জেলা প্রশাসনে জমা দিলেও ঘুরে ফিরে সেই আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীদের নামই উঠে আসছে। এ নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সদস্যরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে নতুন ডিলার নিয়োগ প্রদানের জোর দাবি জানান।
জানা গেছে, গত জুন মাসে টিসিবি’র ১২৪ জন ডিলারের তালিকার মধ্যে অধিকাংশই পলাতক, কয়েক জন মৃত ব্যক্তি ও জুলাই আন্দোলনে হত্যা ও হামলা মামলার আসামিরা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা মিটিং এ আপত্তি উঠলে ঝিনাইদহ প্রশাসন নতুনভাবে তালিকা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্তের নামে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে ঘুরেফিরে সেই আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীদের নাম তালিকায় আবারো তুলে দেন। এ নিয়ে জেলা জুড়ে দুর্নীতিবাজ তদন্ত অফিসারদের নিয়ে চলছে সমালোচনার ঝড়।
অভিযোগ উঠেছে, জেলার ৬ উপজেলায় নতুন নবায়নের ১০৪ জন ডিলারের মধ্যে ৮৭ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নাম রয়েছে। এরমধ্যে বেশির ভাগের নামে মামলা ও ৫ই আগস্টের পর পলাতক রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় তদন্ত করেও তাদের নাম কেন তালিকায় উঠলো তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডে মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতা বীরেন শিকদারের চাচা কুমারেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। ৫নং ওয়ার্ডের ডিলার এনায়েত উল্লাহ তিন লাখ টাকায় তার ডিলারশিপ বিক্রি করে দিলেও তিনি তালিকায় রয়েছেন। সদরের মধুহাটী ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা খায়রুল ইসলামকে ডিলারশিপের সুপারিশ করা হয়েছে। ঝিনাইদহ ১ আসনের এমপি মৃত আব্দুল হাই-এর পিএস রিয়াদের নামে সদর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কলাবাগানে ডিলার রয়েছে, ঝিনাইদহ পৌরসভার পাগলাকানাই ইউনিয়নে একই পরিবারে মেহেরিমা কাসেম ও আফরোজা খানমের নাম তালিকা হয়েছে। হরিশংকরপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতা কনক কান্তি দাসের ভাতিজা বিকাশ কুমার দাসের নাম রয়েছে। ঝিনাইদহ গার্মেন্টস পট্টির এস আর গার্মেন্টসের মালিক মৃত তপন কুমারসহ তার ৪ ভাইয়ের নামেই ৪টি ডিলারশিপ লাইসেন্স রয়েছে। হরিণাকুণ্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মৃত আফজাল উদ্দিনের নামে এখনও তালিকা রয়েছে, হরিণাকুণ্ডুর কাপাশহাটীয়া ইউনিয়নে পতিত সরকারের এমপি সমি সিদ্দিকীর পিএস কামালের চাচা মামুন রশিদ ও চাঁদপুর ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শরিফুলের নাম রয়েছে। নলডাঙ্গা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা এনামের স্বজন শওকত আলীকে দেয়া হয়েছে। কালীগঞ্জের সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সাবেক মেয়র পলাতক বিজুর সহযোগী মোস্তাক আহম্মেদকে দেয়া হয়েছে। এভাবে কালীগঞ্জে টিসিবি’র ১৩ ডিলারের মধ্যে ১৩ জনই ফ্যাসিস্টদের দোসর বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ ছাড়া ঝিনাইদহ সদরে ৩৫ জনের মধ্যে ২৪ জন, হরিণাকুণ্ডুতে ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন, শৈলকুপায় ১৮ জনের মধ্যে ১১ জন ও মহেশপুরে ১৬ জনের মধ্যে ৬ জন পতিত সরকারের দোসর ও সমর্থকদের নাম রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এসব পলাতক আসামি ও নেতাকর্মীরা তাদের নামের ডিলারশিপ বিভিন্ন লোকের নিকট কোটাপ্রতি ১০-১৫ হাজার টাকায় ভাড়া দিয়ে রেখেছে। এদের কারও কোনো মুদি দোকান নাই। অন্য লোকের দোকান দেখিয়ে লাইসেন্স করিয়েছে।
বিষয়খালী বাজারের মুদি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ অভিযোগ করেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের এক অফিস সহকারী তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ নিয়েও তার তালিকায় নাম দেননি। একই উপজেলার চোরকোল বাজারের তরিকুল ও কলমনখালী বাজারের ইকবাল হোসেনও ঘুষ দিয়েও নবায়নের তালিকায় তাদের নাম উঠেনি বলে অভিযোগ করেন।
এদিকে ঝিনাইদহ বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বিশ্বাস ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা আবু হুরায়রা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় টিসিবি’র ডিলারের তালিকায় পতিত সরকারের দোসরদের নাম থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে সদ্য যোগদান কৃত ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসনে আরাকে প্রশ্ন করা হয়, স্বৈরশাসকের সময় ডিএনএ টেস্ট করে আওয়ামী লীগ করে কিনা তারপর তাদের ডিলার দেয়া হয়েছিল। আর যারা আওয়ামী লীগ করে না তাদের সবাইর আবেদন বাতিল করা হয়েছিল।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নীতিমালায় কোথাও কোনো জায়গাই লেখা নাই যে আওয়ামী লীগ করলে তাদের টিসিবি’র লাইসেন্স দেয়া যাবে না। নানা মহল থেকে অভিযোগ ওঠায় ইতিমধ্যে আবারো তদন্ত করে তালিকা পুনরায় করা হয়েছে। তিনি বলেন, এদের মধ্যে ৯৮ জনের নাম আবারো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
সবুজদেশ/এসএএস