ঘুষ নিয়ে বেলালকে আত্মসমর্পণ করায় পুলিশ, রাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত
চট্টগ্রামঃ
দিনে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণের পর রাতে পুলিশের সঙ্গে কথিত অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গিয়ে নিহত হন চট্টগ্রামের খুলশী থানার আমবাগান এলাকার মোহাম্মদ বেলাল। পুলিশের দাবি, অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে সহযোগীদের গুলিতে ১৩ মামলার আসামি বেলাল নিহত হন।
তবে নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ভালো হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আশ্বাসে আত্মসমর্পণ করেন বেলাল। এরপর ওইদিন পরিবারের কাছ থেকে ‘৪৫ হাজার টাকা ঘুষ’ নেওয়ার পরও পুলিশ বেলালকে আদালতে হাজির না করে থানা হাজতে রাখে এবং রাতে কথিত অস্ত্র উদ্ধারে নিয়ে গিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করে। তবে বেলালের পরিবারের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে খুলশী থানার ওসি বলেন, ‘বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে থানায় আত্মসমর্পণ করে বেলাল। তাকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ওইদিন আদালতে পাঠানো হয়নি। আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে তাকে আদালতে হাজির করার কথা ছিল। তবে এর আগে বেলালের দেওয়া তথ্য অনুসারে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সে নিহত হয়।’
নিহত বেলাল কুমিল্লার চান্দিনা থানার কঙ্গাই গ্রামের আব্দুল খালেক বাড়ির মৃত আব্দুল কাদেরের ছেলে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানাধীন আমবাগান পুকুর পাড় এলাকার নাজমুলের কলোনিতে থাকতেন।
পুলিশ জানিয়েছে, বেলালের নামে বিভিন্ন থানায় খুন, ডাকাতি ও মাদকের ১৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে খুলশী থানায় পাঁচটি মামলা রয়েছে। অন্য মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি নগরীর কোতোয়ালী, তিনটি আকবর শাহ, একটি পাহাড়তলী থানা এবং অন্যটি কুমিল্লার তিতাস থানায় দায়ের করা হয়।
এদিকে, বেলালের বোন মিনু আক্তার বলেন, “গতকাল (বুধবার) সকাল ১০টায় আমার ভাই আমাকে কল করে বলে- ‘বোন, আমি থানায় আত্মসমর্পণ করতে আসছি। আত্মসমর্পণ করার পর আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলে জেল খেটে আমি জামিনে বের হবো। তোরা নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করিস।’ কিন্তু পুলিশ আমার ভাইকে বেঁচে থাকতে দেয়নি। তারা আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে।”
পুলিশের ‘ভালো হওয়ার সুযোগ’ দেওয়ার আশ্বাসে বেলাল আত্মসমর্পণ করেন বলে দাবি করেন মিনু আক্তার। তিনি বলেন, ‘ডিসি স্যার (পুলিশের উপ-কমিশনার) আমার ভাইকে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন। এরপর আমার ভাই আত্মসমর্পণ করলে তারা আমাদের কাছে টাকা খেয়েছেন। আবার তারাই আমার ভাইকে মেরেছে।’
পুলিশকে কখন টাকা দিয়েছেন জানতে চাইলে মিনু আক্তার বলেন, ‘গতকাল আত্মসমর্পণের পর পুলিশ ৪৫ হাজার টাকা নিয়েছে। তারা টাকা নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেছে। আবার আমার ভাইকে মারার পরিকল্পনাও করেছে।’
একই অভিযোগ করেন বেলালের আরেক বোন হোসনে আরা। তিনি বলেন, ‘ডিসি স্যার যেমনে যেমনে বলছে, সেইভাবে কাজ করে আমার ভাই আত্মসমর্পণ করে। স্যারের কথায় দুইটি মামলায় ওয়ারেন্ট করিয়েছে। এরপর ডিসি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করেই কাল (বুধবার) আমার ভাই আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ করার পর তারা আমার ভাইকে কারাগারে পাঠিয়ে দেবে বলেছিল।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নিহত বেলালের বড় ছেলে মোহাম্মদ সজিব দাবি করেন, ‘১৩টি মামলার মধ্যে একটি মামলায়ও ওয়ারেন্ট ছিল না। এগুলো অনেক আগের মামলা, সবগুলো মামলায় খালাস হওয়ার পর্যায়ে ছিল। ১৩টি মামলার মধ্যে সর্বশেষ দুই মামলা একবছর ২-৩ মাস আগে মাদকদ্রব্য আইনে দায়ের করা হয়। ওই সময় পুলিশের মাধ্যমে আব্বু জানতে পারে, তাকে গ্রেফতার করলে পুলিশ ক্রসফায়ারে দেবে। এটি জানার পর আব্বু ঢাকায় গিয়ে আত্মগোপন করে। সেখানে তাবলিগে সময় দিতে থাকে।’
আত্মসমর্পণ করার বিষয়ে সজিব বলেন, ‘একবছর আগে আমার দাদা ব্রেনস্টোক করেন। তখন আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর দাদা মারা যান। দাদা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আব্বু মাটি দিতে চট্টগ্রামে আসলে অলংকার মোড় থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তখন নতুন আরেকটি মামলা দিয়ে পুলিশ তাকে কারাগারে পাঠায়। ওই সময় মাস খানেক জেল খেটে জামিনে বের হওয়ার পর আবার ঢাকায় চলে যায় আব্বু। এরপর আমার দাদিও মারা যান। গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে আব্বু তখন দাদিকে মাটি দিতে আসতে পারেননি। এ কারণে তিনি আত্মসমর্পণ করে বাসায় ফিরতে চেয়েছিলেন।’
সজিব আরও বলেন, “আত্মসমর্পণের জন্য রাজু আংকেলের (অনলাইন টেলিভিশন- জেটিভির সাংবাদিক) মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আব্বু। রাজু আংকেল ডিসি (উত্তর) বিজয় বসাক স্যারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তখন স্যার আমাদের জানান, তিনি আগে আব্বুর অপরাধের ফাইল দেখবেন, তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। এরপর দুইমাস আগে তিনি রাজু আংকেলকে বলেন, ‘আমরা বেলালের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছি, তাকে আমরা ভালো হওয়ার সুযোগ দেবো। এর জন্য তাকে থানায় আত্মসমর্পণ করতে হবে।’ এর জন্য তিনি দুই মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করানোর পরামর্শ দেন। এরপর উনার (বিজয় বসাক) পরামর্শে দুই মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করার পর পরশু তিনি (বিজয় বসাক) বলেন, ‘আমি থানায় বলে দেবো। কাল (বুধবার) বেলালকে থানায় আত্মসমর্পণ করতে বলবেন। এরপর তার পরামর্শে বুধবার সকালে থানায় গিয়ে আমার আব্বু আত্মসমর্পণ করেন।’
সজিব বলেন, “ঢাকা থেকে এসে সকালে আব্বু সরাসরি থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। ঢাকা থেকে আসার আগে মোবাইলে আমাদের আত্মসমর্পণ করার কথা জানান। পরে থানায় আসলে সেখানে তার সঙ্গে আমার আম্মু, আমার কাকা, ফুফুদের দেখা হয়। আমরা তখন আব্বুকে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে বলি। তখন ওসি স্যার আমাদের বলেন, ‘আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। এরপর সকালে আদালতে পাঠিয়ে দেবো।’ আমরা রাত ১০টা পর্যন্ত থানায় ছিলাম। ১০টায় বাসায় আসার আগে আমার এক ফুফাতো ভাই রাতে থানার বাইরে থাকতে চায়। পুলিশ তাকে বুঝিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তখন পুলিশ তাকে বলে, ‘আব্বুর কিছু হবে না, সকালে আদালতে পাঠিয়ে দেবো। শুধু শুধু এখানে ভিড় করে লাভ কী।”
তিনি আরও বলেন, “এরপর সকাল সাড়ে ৬টায় আমার আম্মু নাস্তা নিয়ে গিয়ে দেখে আব্বু থানায় নেই। পরে পুলিশের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, ‘উনি তো নেই; তাকে অভিযানে নিয়ে গেছে।’ আমরা সকাল ৮টা পর্যন্ত থানার বাইরে বসে অপেক্ষা করি। পরে আমাদের আত্মীয়স্বজন কল করে জানায়, ‘বেলালকে তো ক্রসফায়ারে দিছে। টেলিভেশনে খবর দেখাচ্ছে।’ এরপর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আব্বুর লাশ হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে। তারপর ১২টার দিকে আমরা এখানে চলে আসি।’
সজিব অভিযোগ করেন, ‘আব্বুর আত্মসমর্পণের পর থানার সেকেন্ড অফিসার নুর উদ্দিন স্যার এসে চা-পানি খাওয়ার কথা বলে ওসি স্যারের জন্য ৩০ হাজার টাকা, তদন্ত অফিসারের জন্য ১০ হাজার টাকা এবং তার নিজের জন্য ৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এর আগে ক্রসফায়ারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে খুলশী থানার তৎকালীন ওসি শেখ নাছির উদ্দিন আমাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন।’ এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দিয়েছেন বলেও তিনি জানান।
পুলিশকে টাকা দেওয়ার বিষয়ে কোনও প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘুষ তো মানুষ গোপনে নেয়। তখন পুলিশের আচরণ অনেক ভালো ছিল। তাই আমরা প্রমাণ রাখার কৌশল অবলম্বন করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, পুলিশ ধোঁকা দেবে না। তারপরও আপনার যদি সন্দেহ হয়, তবে আপনি স্বর্ণকারের দোকানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারবেন। আমার দাদুর একটা স্বর্ণের হার বিক্রি করে আমরা টাকাগুলো নিয়েছিলাম।’
এ অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে খুলশী থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই নুর উদ্দিন বলেন, ‘বেলালের পরিবারের কাছ থেকে কাল (বুধবার) কোনও টাকা নেওয়া হয়নি। এটি মিথ্যা অভিযোগ। আত্মসসমর্পণ করার পর থানায় আসা বেলালের পরিবারের কারও সঙ্গে আমার কথা হয়নি।’
একই কথা জানিয়েছেন ওসি প্রণব চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা সঙ্গে বেলালের পরিবারের কারও কথা হয়নি। তাহলে টাকা নেবো কীভাবে? এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’
সকালে আত্মসমর্পণ করার পরও বুধবার কেন বেলালকে আদালতে পাঠানো হয়নি, জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘তাকে আমরা থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করবো। তাই বুধবার আদালতে পাঠানো হয়নি।’ বেলাল সকালে নয়, দুপুর দেড়টার দিকে আত্মসমর্পণ করে বলে দাবি করেন তিনি।
ওসি প্রণব চৌধুরী আরও বলেন, ‘আত্মসমর্পণ করার পর আজ (বৃহস্পতিবার) বেলালকে আদালতে প্রেরণ করার কথা ছিল। কিন্তু রাতে তাকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তার কাছে থাকা অস্ত্রগুলো জালালাবাদ এলাকায় লুকানো আছে বলে জানায় সে। এরপর তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে সেখানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে বেলাল গুলিবিদ্ধ হয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক বলেন, ‘‘আমার সঙ্গে তার (বেলাল) পরিবারের কারও কথা হয়নি। অনলাইন টেলিভিশন ‘জেটিভি’র এক রিপোর্টার (রাজু) বেলালের বিষয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন আমি বলেছিলাম, বেলালকে ভালো হওয়ার সুযোগ দেওয়া যায় কিনা আমরা দেখবো। এরপর তো বেলাল নিজেই থানায় গিয়ে কাল (বুধবার) আত্মসমর্পণ করলো। আত্মসমর্পণ করার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারে, ডাকাতির সময় ব্যবহার করা অস্ত্রগুলো তার সহযোগীদের কাছে আছে। পরে রাতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে সেখানে গোলাগুলিতে বেলাল নিহত হয়।’’