ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের গান গাইলেন ইসরাইলের সেরা শিল্পী
সবুজদেশ ডেস্কঃ
ইসরাইলি গায়িকা আমাল মুরকুস বেশ ব্যস্ত দিন পার করলেন। বিকেলে কাফর ইয়াসিফ শহরে শিশুদের বই পড়া অবস্থায় নিজের একটি ভিডিও শ্যুট করেন। সেটা পাঠান শিশুদের বই পড়ায় উৎসাহিত করতে কাজ করা তিউনিশিয় একটি সংগঠনের কাছে। সন্ধ্যায় যান মোশাভ ইভেন মেনাহেম শহরের এক স্টুডিওতে। সেখানে ২৯শে নভেম্বর ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দিবসের জন্য একটি ফিলিস্তিনি লোকগীতি গাওয়ার ভিডিও তৈরি করেন।
স্টুডিওর সেশনটিতে তার সম্প্রতি প্রকাশিত অপর একটি গানও পুনরায় রেকর্ড করেন মুরকুস। গানটার প্রথম রেকর্ডিং নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। তিনি বলেন, আমি গানের শুরুটা একইসঙ্গে উদ্যমী ও ধীর গতির করতে চেয়েছিলাম।
মুরকুস যেভাব চান, সেভাবে গান গাওয়া প্রায় অসম্ভব কাজ বলে মনে হয়। কিন্তু তিনি ইসরাইলের সেরা সঙ্গীতশিল্পীদের একজন।
তার নতুন গান ‘দোলা’ সত্তুরের দশকে ফিলিস্তিনি কবি সামিহ আল-কাশিমের লেখা এক কবিতার উপর ভিত্তি করে গাওয়া। সামিহর বেশিরভাগ কবিতাই আরবিতে লেখা। আগের একটি এলবামেও ‘ফাত্তাহ আল ওয়ার্দ’ নামে সামিহর একটি কবিতাকে গানে রূপ দিয়েছেন মুরকুস।
দোলা লেখা হয়েছিল স্থানীয় ভাষায়। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। দোলা শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। দোলা মানে দেশ। আবার মিসরীয় ভাষায় ‘ওই মানুষেরা’ বোঝায়। আরবিতে অর্থের উপর ভিত্তি করে শব্দটি লেখাও হয় ভিন্নভাবে। আল-কাসিমের লেখা প্রায় সব কবিতাতেই শব্দটি লেখা হয়েছে ‘ওই মানুষদের’ বুঝিয়ে। এ অর্থ হিসেবে কবিতাটির অর্থ দাঁড়ায়, ওই মানুষেরা আমাকে আমার ভূমি থেকে বঞ্চিত করেছে/ ওই মানুষেরা আমার সম্মানকে পদদলিত করেছে। কিন্তু উভয় ‘দোলা’র উচ্চারণ একই হওয়ায় আরবিভাষীরা গানটি শোনার সময় দোলাকে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবেও শুনে থাকে। এভাবে শুনলে গানটির অর্থ হয় এমন- রাষ্ট্র আমায় প্রত্যাখ্যান করেছে, রাষ্ট্র আমার সম্মান পদদলিত করেছে।
মুরকুসের জন্ম ১৯৬৮ সালে। তার বাবা নিমর মুরকুস ছিলেন কাফর ইয়াসিফ শহরের স্থানীয় পরিষদের প্রধান ও আল-কাসিমের বন্ধু। আল-কাসিম যখন দোলা কবিতাটি লিখেছিলেন তখন মুরকুস ছিলেন ছোট্ট এক মেয়ে। মুরকুস বলেন, আমি একবার সামিহকে এক বিক্ষোভে কবিতাটি আবৃত্তি করতে দেখেছিলাম। মানুষ মঞ্চে সামিহকে আবৃত্তি করতে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। হাত নেড়ে নেড়ে বলছিল ‘ওয়াও’!
মুরকুস জানান, দোলা কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনেই পরিচিত নয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের সুপরিচিত হয়ে উঠেছে গানটি। তিনি বলেন, গানটির সুর মিসরীয় স্টাইলে অত্যন্ত ছন্দময়। আল-কাসিমের তত্ত্বাবধায়নে গানটির সুর করেছিলেন রাজব আল-সুলুহু। আল-কাসিম চেয়েছিলেন দোলার সুর যেন লোকগীতির মতো হয়, সহজ, হাস্যরসে ভরপুর, নাচা যায় এমন।
মুরকুস বলেন, গানটি নিয়ে কাজ করার সময় আগে গানটি গেয়েছেন এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। তারা জানান, আল-কাসিম তাদের বলেছিলেন, তিনি চান গানটি রাজনৈতিক হোক, কিন্তু এর সুরে যেন একজন বেলি ড্যান্সারও নাচতে পারেন।
হিব্রুভাষী ইসরাইলিরা অবশ্য গানটি খুব একটা শুনতে পান না। মুরকুসের গান হিব্রু রেডিও স্টেশনগুলোয় খুব একটা সম্প্রচার করা হয় না। অবশ্য প্রকাশের পরপর আরবীভাষী মাকান রেডিও স্টেশনে কয়েকবার গানটি প্রচারিত হয়েছিল।
‘শিয়ে ফিল হারাভ’ নামে মুরকুসের অপর একটি রাজনৈতিক গানও প্রচার করেছিল মাকান। যদিও কিছুটা কাটছাট করে এই গানটি লিখেছিলেন তৌফিক জায়াদ। এটি যুদ্ধবিরতীর গান। এর শেষ লাইনটির অনুবাদ এমন- আমি একটি যুদ্ধের জন্যই গান গাই- মুক্তির যুদ্ধ।
মুরকুস বলেন, তৌফিক ফিলিস্তিনিদের মুক্তির কথা বলছিলেন, তাদের দখল হওয়া ভূমির কথা বলছিলেন।
দোলা অবশ্য অনেকটা কম রাজনৈতিক ঘরানার। মুরকুস বলেন, এতে ইসরাইল বা ফিলিস্তিনের কথা উল্লেখ নেই। সবাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কোন দেশ ভূমি দখল করেছে?
মুরকুসের গানগুলোয় যে বর্ণনা দেওয়া হয় তা যেমন সবসময় ইসরাইলের পক্ষে যায় না, তেমনি কয়েক বছর ধরে আরব সমাজেও তার গানগুলো আগের মতো আর সমাদৃত হচ্ছে না। ফিলিস্তিনের ইসরাইল বয়কট আন্দোলনকারীদেরও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন তিনি।
পাঁচ বছর আগে ইসরাইলের একটি শীর্ষ ব্যান্ড মুরকুসের কিছু গানের জ্যাজ সংস্করণ নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিল। মুরকুস খুশি হয়ে অনুমতি দিয়েছিলেন। এই প্রথম ইহুদি জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পীরা তার কাজকে স্বীকৃতি দিচ্ছিল। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ আগেই বয়কট আন্দোলনকারীদের এক প্রতিনিধি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বলেন, তিনি যদি ওই অনুষ্ঠান বাতিল না করেন, তাহলে আন্দোলনকারীরা তাকে বয়কট করবে।
মুরকুস ওই প্রতিনিধিকে জানান, আমি গান গাইবো কিনা তা আমি ঠিক করবো। আপনারাতো আগে কখনো আমার গানের প্রশংসা করতে ফোন দেননি। এখন কেন দিচ্ছেন? আমি এসব ফাঁদ বুঝি।
বয়কট আন্দোলনের নীতি হচ্ছে, ইসরাইলকে এড়িয়ে চলা। এটি একটি অত্যাচারী রাষ্ট্র। মুরকুস বলেন, আমি এসবই বুঝি। কিন্তু ফিলিস্তিনি শিল্পীরা আছেন সংকটে, তারা গাইতে চান, জীবিকা অর্জন করতে চান। আর এর মাঝে যদি কেউ এসে বলে যে, আমরা আপনার বিক্ষোভের কথাপূর্ণ গানগুলো নিচ্ছি, শরণার্থী ফেরত আসার গানগুলোও নিচ্ছি। আমি তাদের কিভাবে না করবো? মুরকুস জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে ওই অনুষ্ঠানটি করেন।
তবে এর ফলে এ বছর তেমন কোনো লাইভ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার প্রস্তাব পাননি মুরকুস। তিনি বলেন, গত জুলাই থেকে আমি একটা পয়সাও আয় করিনি। আমার কোনো সঞ্চয় বা ভাতাও নেই। আমি চিন্তিত।
তবে তিনি এও বলেন, হতাশা আছে, কিন্তু আমি মনে করি, হতাশাও ভালো। অনেক নারী রাস্তা-ঘাটে খুন হচ্ছেন, অনেক মানুষ অস্বীকৃত গ্রামে বাস করছেন, শরণার্থীরা জীবিকার জন্য লড়ছেন। আমি বুঝি কেন মানুষ হতাশ হয়, কিন্তু সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।
করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) সময় শিল্পীদের সহায়তা করতে, গত গ্রীষ্মে ফিলিস্তিনি-ইসরাইলি শিল্পীদের একটি দল গঠন করেন মুরকুস। তবে দলটি গঠনের পেছনে আরো বড় উদ্দেশ্য ছিল বিস্তৃত পরিসরে সতীর্থদের জাগিয়ে তোলা, একত্রিত করা এবং জনগণের মধ্যে তারা কি রকম কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা।
ইসরাইলি রেডিওগুলোয় ফিলিস্তিনি শিল্পীদের গান প্রচার করা হয় না। বাধ্য হয়ে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাইতে হয়। মুরকুসের মতে, এখানে সঙ্গীতের সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই।
(হারেৎস অবলম্বনে। মূল প্রতিবেদনটি লিখেছেন বেন শালেভ।)