আসন ছাড়ে সন্তুষ্ট নয় আ.লীগের মিত্ররা
সবুজদেশ ডেক্সঃ আওয়ামী লীগ জোটের শরিক ও মিত্রদের যে সংখ্যক আসন ছাড় দিতে চায়, তাতে কেউ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। এ কারণে গতকাল পর্যন্ত চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে ক্ষমতাসীন দল। যদিও দলটির নেতারা এটাকে নির্বাচনী ‘কৌশল’ বলে দাবি করছেন।
গত রোববার থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেওয়া শুরু করে। গতকাল সোমবার দল, জোট ও মিত্রদের আসন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার জন্য বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকে আওয়ামী লীগ। একই সময় বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়েও সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। শেষ পর্যন্ত কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেনি। আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে ১৪ দলের শরিকেরাও প্রতিক্রিয়া জানাবে—এমন আভাস পাওয়া গিয়েছিল। সেটাও আর হয়নি।
এদিকে গতকাল দুপুরে জাতীয় পার্টি (জাপা) ২০০ আসনে সম্ভাব্য দলের প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দেওয়া শুরু করে। সন্ধ্যার পর দলটি ৪৭টি আসনের প্রার্থী তালিকা ঠিক করে তা গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, তারা এইচ এম এরশাদের জাপাকে ৪০ আসনের বেশি দিতে চাচ্ছে না। চল্লিশের বেশি আসনের বিষয়ে জাপা অনড় থাকলে অতিরিক্ত আসনগুলো উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও অন্য মিত্রদের প্রার্থী থাকতে পারবে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, দলটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ২৫০টি মনোনয়নের চিঠি বিলি করা হয়েছে। কিছু আসনে দুজনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অবশ্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ২৩১ আসনে দলের প্রার্থীদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, দলীয় চিঠি দেওয়া হয়েছে এমন আসনেও জোটের শরিকদের বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন পর্যন্ত এই সুযোগ থাকছে। জাতীয় পার্টিও বলছে, আসন চূড়ান্ত হলে অন্যদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হবে।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের জোট হচ্ছে ১৪ দল। বর্তমান সংসদে শরিকদের চারটি দলের ১৫ জন সাংসদ আছেন। তবে গতকাল পর্যন্ত ওই চারটি শরিক দল ১২টি আসনের নিশ্চয়তা পেয়েছে। আসন কমার কারণে তারা ক্ষুব্ধ। কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেসব শরিকের বর্তমানে কোনো সাংসদ নেই, আগামী নির্বাচনেও কোনো আসন পাচ্ছে না, তাদের মধ্যেও অসন্তোষ আছে।
গতকাল সংবাদ সম্মেলন ডেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ না করায় সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘পূর্বঘোষণা অনুযায়ী আজ জোটের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না। কারিগরি ও কৌশলগত (টেকনিক্যাল এবং স্ট্র্যাটেজিক্যাল) কারণে জোটগত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হচ্ছে না।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি ও বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও নিজ নিজ প্রার্থীদের মনোনয়নের চিঠি দিচ্ছে। পরে সবার তালিকা যাচাই–বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ৬৫ থেকে ৭০ আসন ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ মাঠপর্যায়ে আরেকটি জরিপ করবে। কিছু আসনে একাধিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। কে আসলে জনগণের কাছে বেশি জনপ্রিয়, এটা বিবেচনায় নেওয়া হবে। আবার কোনো প্রার্থী ঋণখেলাপির মধ্যেও থাকতে পারেন।
জাপার সঙ্গে দর–কষাকষি
মহাজোটের বড় শরিক জাপা কটি আসন পাচ্ছে—এটি এখনো পরিষ্কার করেনি আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি যে ৪৭ আসনের প্রার্থী তালিকা করেছে, এর অন্তত ১৪টিতে আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম–৯ আসনের জাপার সাংসদ জিয়াউদ্দিন আহমেদের (বাবলু) আসনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুহিবুল হাসান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পরে জিয়াউদ্দিনকে কক্সবাজার–৩ আসনে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপা। অবশ্য আওয়ামী লীগও কক্সবাজার–৩ আসনে বর্তমান সাংসদ সাইমুম সরওয়ারকে দিয়ে রেখেছে। এমন জটিলতা আছে ঢাকা–১৭ আসনেও। জাপার তালিকায় এখানে প্রার্থী এইচ এম এরশাদ। তবে আওয়ামী লীগ চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ওরফে ফারুককে মনোনয়ন দিয়েছে।
ময়মনসিংহ–৪ ও ময়মনসিংহ–৭ আসনে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে জাপা মহাজোটের প্রার্থী বিবেচনা করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ শুধু ময়মনসিংহ–৪ ছাড়তে রাজি। অন্যটিতে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ রুহুল আমিন মাদানীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
কুমিল্লা–২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বারের সভাপতি সেলিমা আহমাদকে। জাপা বর্তমান সাংসদ আমির হোসেন ভূঁইয়াকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ধরে রেখেছে।
গতকাল বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ইতিমধ্যে এরশাদের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোট, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের সঙ্গে রূপরেখা নির্ণয় করা হয়েছে। সমঝোতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। মহাজোটগতভাবেই নির্বাচন করা হবে। তবে তাঁর দল প্রায় ২০০ আসনেই মনোনয়নপত্র দাখিল করবে।
সংবাদ সম্মেলনের পরপরই দলীয় প্রার্থীরা মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় কয়েকজনের হাতে দলীয় মনোনয়নপত্র তুলে দেওয়া হয়। কাউকে কাউকে প্রার্থীর নামের ঘর ফাঁকা রেখেই মনোনয়ন ফরম দিতে দেখা গেছে।
শরিকেরা হতাশ ১৪ দলের
বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির ছয়জন সাংসদ রয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে জাতীয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা নড়াইল–২ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ায় সেখানকার ওয়ার্কার্স পার্টির সাংসদ হাফিজুর রহমান বাদ পড়েছেন। বাকি পাঁচটি আসন নিশ্চিত কি না, নিশ্চিত নন দলটির নেতারা।
বর্তমানে জাসদের (ইনু) তিনজন সাংসদ আছেন। এর মধ্যে তথ্যমন্ত্রী ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতারের আসন দুটি নিশ্চিত করা হয়েছে। বগুড়া থেকে রেজাউল করিমের আসনটির জন্য চেষ্টা করছে জাসদ। এখন সবকিছু নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
বাংলাদেশ জাসদের (আম্বিয়া) দুজন সাংসদ আছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে মইন উদ্দীন খান বাদলের আসন নিশ্চিত করা হয়েছে। পঞ্চগড়–১ নাজমুল হক প্রধানের আসনে আওয়ামী লীগ মোজাহারুল হক প্রধানকে মনোনয়ন দিয়েছে। এই অবস্থায় নাজমুল হক প্রধানসহ কয়েকজনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতীয় পার্টির (জেপি) সভাপতি ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিরোজপুর থেকে মনোনয়ন নিশ্চিত। দলটির মহাসচিব শেখ শহিদুল ইসলাম ইসলাম ঢাকা–১৮ আসনের জন্য চেষ্টা করছেন।
১৪ দলের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আসলে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি। কিছু আসন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরেকজন নেতা বলেন, জোটের চারটি দলের বাইরে বাকিদের আর কী কাজ আছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, জোটের মনোনয়ন চারটি দলেই সীমাবদ্ধ।
ধর্মভিত্তিক দলে জটিলতা
প্রয়াত ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের মিত্র হয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে তৎপর ছিল। কিন্তু আসন সমঝোতায় সুবিধা করতে না পেরে তাদের নির্বাচন করাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসন থেকে দলের সহসভাপতি আবুল হাসানাত আমিনী ও কুমিল্লা–১ থেকে আলতাফ হোসেন প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়া–১ আসনে বর্তমান সাংসদ জাতীয় পার্টির জিয়াউল হক মৃধা। এই আসন জাতীয় পার্টিকেই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইসলামী ঐক্যজোটকে বলা হয়েছে, তারা চাইলে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে পারে। জাপা লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে ভোট করবে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ইসলামী ঐক্যজোটকে জয়ী করতে কাজ করবেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে ইসলামী ঐক্যজোট রাজি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। অন্যদিকে কুমিল্লা–১ আসনে আওয়ামী লীগ বর্তমান সাংসদ সুবিদ আলী ভূঁইয়াকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছে। ফলে ইসলামী ঐক্যজোটের আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে থাকা কঠিনই।
১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনের দুজন সাংসদ আছেন। দলটির সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে চট্টগ্রাম–২ আসন ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে দলটির সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল লক্ষ্মীপুর–১ আসনের সাংসদ। তাঁকে বাদ দিয়ে রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের মালিক আনোয়ার হোসেন খানকে নিয়ে মাঠে নামেন নজিবুল বশর। টের পেয়ে আউয়াল ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স নামের একটি জোট করে প্রার্থী হতে তৎপর হন। সম্প্রতি তরীকত ফেডারেশন আউয়ালকে বহিষ্কার করে এবং আনোয়ার খানকে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগ এই আসনে প্রার্থী দেয়নি। আনোয়ার খানই মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আনোয়ার খান আওয়ামী লীগের প্রার্থী, নাকি তরীকত ফেডারেশনের প্রার্থী—এ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, এই মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক টাকার খেলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন ৪ হাজার ২৩টি। এর একটা বড় অংশই ছিল তরুণ, সাবেক ছাত্রনেতা। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বড় কোনো পরিবর্তন নেই। ফলে অনেকেই হতাশ, ইতিমধ্যে কিছু কিছু স্থানে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও সারা দেশে অনেকে ক্ষুব্ধ। এর সঙ্গে জোট ও মিত্রদের দ্বন্দ্ব মেটাতে না পারলে এর প্রভাব ভোটে পড়তে পারে বলে দলের নেতারা মনে করছেন।