হাসিনাকে ফেরত পাঠানো নিয়ে কি ভাবছে ভারত
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে তাকে ফেরত চেয়ে ভারতের কাছে কূটনৈতিক বার্তা (নোট ভার্বাল) পাঠানো হয়েছে। এর জবাব না পেলে অনুস্মারক পত্র পাঠানোর কথা জানানো হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। ভারতের মনোভাব বুঝে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
এদিকে বাংলাদেশের পাঠানো কূটনৈতিক বার্তা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় করণীয় সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। বন্দি বিনিময় চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইলেও ভারতে তিনি রয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে। একজন রাজনৈতিক আশ্রিত ব্যক্তিকে এভাবে ফেরত পাঠানো কতটা সমীচীন হবে সেটার আইনি নানা দিক সম্পর্কে ভাবছে ভারত সরকার। এখনই এ ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু জানাবে না দেশটি। এর জন্য কয়েক মাস সময় নেওয়া হতে পারে। তবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যাতে সম্পর্কের আরও অবনতি না হয় সে ব্যাপারটিও দেশটির ভাবনায় রয়েছে।
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো সম্পর্কে ভারত সরকারের মনোভাব তুলে ধরে বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকা একটি সংবাদ দিয়েছে। ‘হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়ে চিঠি: আইনি দিক খতিয়ে দেখেই ঢাকাকে জবাব, সিদ্ধান্ত নয়াদিল্লির’ শীর্ষক সংবাদে এই ইস্যুতে ভারতের মনোভাব অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে।
আনন্দবাজার লিখেছে- ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পাঠানো কূটনৈতিক বার্তার ‘আইনি বৈধতা’ কতটা, খতিয়ে দেখবে নয়াদিল্লি। কোনও অন্তর্বর্তী সরকার অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের কাছে কোনও রাজনৈতিক নেতার প্রত্যর্পণ চাইলে, তার সমস্ত আইনি দিকগুলি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেই বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বার্তার (নোট ভার্বাল) উত্তর অবশ্যই দেওয়া হবে ‘যথাসময়ে’। কিন্তু তার জন্য কোনও তাড়াহুড়ো করা হবে না। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, সব দিক খতিয়ে দেখে জবাব দিতে কয়েক মাস লাগতে পারে।
আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়, ‘নয়াদিল্লির একাংশের বক্তব্য, বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীর ঢাকা সফরের পরে পরিবেশের যে উন্নতির সম্ভাবনা আশা করা হয়েছিল, এই ‘নোট ভার্বাল’টি তার সঙ্গে মানানসই নয়। এক কর্তার কথায়, ‘ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকুক বা না থাকুক, রাজনৈতিক কারণে আশ্রয় নেওয়া কোনও নেতা বা নেত্রীকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফেরত পাঠাতে কোনও দেশ বাধ্য কি না, তার আইনি দিক দেখা হবে। ভারতের তরফে অন্তত ৫০টি প্রত্যর্পণের আবেদন পড়ে রয়েছে ওয়াশিংটনে। গোটা বিশ্ব ধরলে যার সংখ্যা (প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত ভারতীয় অনুরোধ) একশোর বেশি।
পত্রিকাটির খবরে উল্লেখ করা হয়- ‘পাশাপাশি কূটনৈতিক সূত্রে এ কথাও বলা হচ্ছে, ভারত যদি শেখ হাসিনাকে তাঁর জীবননাশের সম্ভাবনার আশঙ্কা সত্ত্বেও (বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেমন, তাতে শেখ মুজিবরের হত্যার ইতিহাসকেও ফিরে দেখা হচ্ছে) ফেরত পাঠিয়ে দেয়, তা হলে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ শক্তি হিসাবে তার কূটনৈতিক অবস্থান অনেকটাই লঘু হয়ে যাবে ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপালের মতো দেশের কাছে।
আনন্দবাজারের খবর অনুযায়ী, ‘নয়াদিল্লি সূত্র মনে করছে, বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতি থেকে নজর ঘোরাতে এবং সে দেশের ভারত-বিরোধিতার পালে বাতাস লাগাতেই এই ‘নোট ভার্বাল’ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সে দেশের প্রধান শিল্পক্ষেত্র, বস্ত্র কারখানাগুলি থেকে হাজারে হাজারে ছাঁটাই চলছে। বিদেশে রফতানি কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ারে টান, বাজারে আগুন দাম। সব মিলিয়ে কোণঠাসা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নিজেদের স্বার্থেই আওয়ামী লীগ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের তাস খেলছে। অন্তর্বর্তী সরকার গত চার মাসে এমন কিছু দিতে পারেনি যাতে বাংলাদেশের মানুষের স্বস্তি মেলে।
আনন্দবাজারের ভাষ্য- ‘বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্তার কথায়, ‘হাসিনা এখানে যে আশ্রয় চেয়েছেন এবং সেটা যে ভারতের সুপ্রাচীন ‘অতিথি দেবো ভব’ নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ— এ কথা স্পষ্ট ভাবেই বলে এসেছিলেন বিদেশসচিব। তার সঙ্গে এটাও বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বার্থের কথা ভেবেই ভারত যা করার করতে চায়। বাংলাদেশে আগুন জ্বললে তার ধোঁয়া সবার আগে ভারতের রাজ্যগুলিতেই আসবে। ফলে দু’দেশের স্বার্থেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শান্তিপূর্ণ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। সে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার দিকটিকেও মাথায় রাখতে হবে।’ বাংলাদেশের সরকারকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় রফতানি বন্ধ করার পথেও যে হাঁটা হবে না, সে কথা বারবার জানিয়েছে সাউথ ব্লক। কারণ, সেই পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থকে ব্যাহত করবে। কালক্রমে তা ভারত-বিরোধিতায় উস্কানি দেবে।
আনন্দবাজার লিখেছে- ‘সূত্রের বক্তব্য, ভারতও চায় বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দ্রুত নির্বাচন সম্পন্ন করুক অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি-র একাংশ যোগাযোগ রাখছেন ভারতীয়নেতৃত্বের সঙ্গে। বিএনপি-ও ইউনূস সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে ভোটের জন্য। আপাতত নজর রাখা হচ্ছে, আগামী ২০ জানুয়ারির দিকে। অর্থাৎ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্প বসার পর বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের গতিবিধিতে কিছু পরিবর্তন আসে কি না, তার দিকে। বারবার ভারতের উপর নানা ভাবে চাপ তৈরি করা এবং উগ্র ভারত-বিরোধী আবেগ জিইয়ে রাখার ব্যাপারে পাকিস্তানকে সামনে রেখে চিনের কোনও ভূমিকা রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সবুজদেশ/এসইউ