মাহে রমজান আমাদের মাঝে এসেছে তাকওয়া আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম এবং মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের ইস্পাতদৃঢ় চেতনা নিয়ে। নানা কারণে ও তাৎপর্যে এ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, টানা এক মাস রোজা রাখেন মুসলমানরা।
কেবল ধর্মীয় তাৎপর্যই নয়, পাশাপাশি মেডিকেল সায়েন্সেও রোজা রাখার দারুণ কিছু উপকারিতা রয়েছে বলে জানান যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের শিক্ষক ও সহায় হেলথের সহপ্রতিষ্ঠাতা ডা. তাসনিম জারা। একটি ভিডিওতে তিনি জানান রোজা রাখার কিছু উপকারিতার কথা এবং কীভাবে উপকারিতাগুলো সর্বোচ্চভাবে পেতে পারেন সে সম্পর্কে—
১. অটোফেজির মাধ্যমে তারুণ্য ধরে রাখা
জাপানের একজন নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানীর গবেষণা বলছে, রোজা রাখার ফলে তারুণ্য ধরে রাখা সম্ভব। আমাদের সারা শরীরে ট্রিলিয়ন ট্রিলয়ন কোষ দিয়ে গঠিত। প্রত্যেকটা কোষ ছোট ছোট কারখানার মতো। এগুলোতে সারাক্ষণ কাজ চলে। এ প্রক্রিয়ায় কোষে বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি হয়। এ সব বর্জ্য কোষ নিজেই অটোফেজি নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপসারণ ও আবার ব্যবহার উপযোগী করে তুলে। কোষকে সতেজ করে তুলে এবং তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে। এই প্রক্রিয়া ঠিকভাবে না হওয়ার সঙ্গে অ্যালজেইমার্স, পারকিনসনের মতো মস্তিষ্কের রোগগুলোর সম্পর্ক থাকতে পারে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। আমরা যখন সারাক্ষণ খাবার খেতে থাকি, তখন এই অটোফেজি প্রক্রিয়া দমে থাকে। অন্যদিকে রোজা অবস্থায় অটোফেজি বেড়ে যায়। এ সময় কোষগুলো অধিক হারে মেরামত হয়। অনেকে মনে করেন খাবার না খেলে শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে ধারণাটি ঠিক নয়। রোজা রাখা অবস্থায় উল্টো কোষের মেরামতের কাজ বেড়ে যায়। রোজা ছাড়াও অটোফেজি প্রক্রিয়া বাড়ানো যায় ঘাম ঝরানো ব্যায়ামের মাধ্যমে।
২. মেটাবলিক সুইচ করে চর্বি কমিয়ে ফেলা
আমাদের শরীর চালানোর জন্য জ্বালানির প্রয়োজন হয়। শরীর সেটি খাবার থেকে বা আগে থেকে জমিয়ে রাখা এক প্রকার গ্লাইকুজেন বা চিনি থেকে নিয়ে থাকে। আমরা যখন রোজা থাকি তখন ১০-১২ ঘণ্টায় এটি সাধারণত শেষ হয়ে আসে। আমাদেরকে চালানোর জন্য তখন আগে থেকে জমানো চর্বিতে হাত দিতে হয়। এটাকে মেটাবলিক সুইচ বলে। অর্থাৎ চিনি থেকে সুইচ করে চর্বিতে আসা। গবেষণায় দেখা গেছে, এ সুইচের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উপকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের হার্ট ভালো রাখা, পেটের চর্বি কমা, রক্তচাপ কমা, রক্তে চিনির পরিমাণ কমার মতো বেশ কিছু উপকার জড়িত এর সঙ্গে। তবে রোজা রেখে ভাজাপোড়া খেলে কিন্তু এসব উপকার পাবেন না, উল্টো হবে হার্টের ক্ষতি। রোজা রেখে শরীরের যে উপকার হচ্ছে, সেটা পুরোপুরি পেতে চাইলে অস্বাস্থ্যকর ভাজাপোড়া বা ট্রান্সফ্যাট আছে এমন খাবার খাওয়া যাবে না।
৩. পেটের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া
আমাদের নাড়িভুঁড়িতে অনেক ধরনের জীবাণু থাকে। এগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধিসহ অনেক ভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। না খেয়ে থাকলে আমাদের পেটে উপকারী জীবাণুর সংখ্যা বাড়ে। উপকারী জীবাণু থেকে আরও বেশি উপকার পেতে টক দই ও আঁশজাতীয় খাবার খেতে পারেন।
৪. ওজন কমা
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করা ৩৫টি গবেষণা একত্রিত করে দেখা গেছে, এক মাস টানা রোজা রাখলে গড়ে এক থেকে দেড় কেজি ওজন কমে।
৫. রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
রক্তে সুগারের মাত্রা থেকে বুঝা যায়, পরবর্তীতে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কেমন। নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে বেশি থাকলে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তুরষ্ক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের ১৬টি গবেষণায় দেখা গেছে রোজা রাখলে নারী-পুরুষ উভয়ের রক্তে সুগারের অবস্থা ভালো হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার এক গবেষকরা ২৮টি গবেষণার ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন রোজা রাখা ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও উপকার রয়েছে। তবে রোজা রাখার পাশাপাশি পুরো খাদ্যসশ্য খাওয়া বাড়ান, এতেও উন্নতি হবে ব্লাড সুগারের।
৬. রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ
আমাদের রক্তে একধরণের চর্বি থাকে যাকে কোলেস্টেরল বলে। কোলেস্টেরল অনেক বেশি পরিমাণে থাকলে রক্তনালীতে চর্বি জমে তা সরু হয়ে যেতে পারে। ফলে হার্ট অ্যাটাক-স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। রোজা রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে। আরব-আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরবের গবেষকরা সারাবিশ্বে করা ৯১টি গবেষণার ফল পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, রোজায় কোলেস্টেরল আগের থেকে ভালো নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রোজার পাশাপাশি খাবারে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেও কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৭. ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণ
২০১৯ সালে লন্ডনের পাঁচটি মসজিদে একটি গবেষণা হয়। যার নাম ‘লন্ডন রামাদান স্টাডিজ’। এতে রামজানের আগে পরে ব্লাড প্রেশার মেপে দেখা হয় কোনও পরিবর্তন আছে কি না। সেখানে দেখা যায়, উপরের ব্লাড প্রেশার গড়ে ৭ মিলিমিটার মার্কারি আর নিচেরটি ৩ মিলিমিটার মর্কোরি কমেছে। ভারত, পাকিস্তানসহ আরও ৩২টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে রমজানে ওজন না কমলেও ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে উন্নতি আসে। স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে পরিবর্তন আরও বেশি চোখে পড়বে।
সবুজদেশ/এসইউ