এপ্রিলের গোড়ার দিকের কথা। গাজার পূর্বাঞ্চল থেকে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে শহর ছাড়ার নির্দেশ দেয় ইসরাইলি বাহিনী। চলতি মাসে আরও কয়েকবার স্থানচ্যুতির নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইলের বর্বর সেনাবাহিনী। যার মধ্যে শুজাইয়া, জেইতুন এবং তুফাহ অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত ছিল। গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত ১৮ মাসে অন্তত কয়েকশবার এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল।
সকালে উত্তর থেকে দক্ষিণ, বিকালেই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে ভূমধ্যসাগরের ঢেউ- দানব বাতাসের তাণ্ডবে দলবেঁধে আছড়ে পড়ছে সৈকতে, পরক্ষণেই আবার ফিরছে নিজ ঠিকানায়! একই দশা এখন গাজাবাসীরও। ছোট্ট একটা নোটিশ; এলাকা ছাড়ো! অমনি প্রাণ হাতে নিয়ে ছুট! কিন্তু আর কত? ছুটতে ছুটতে সবাই ক্লান্ত! বিরক্তি এসে গেছে জীবনের প্রতি! রুখে দাঁড়াচ্ছে অনেকেই— আর স্থানচ্যুতি নয়! যাওয়ার জায়গাটাই বা আর কোথায়— ঘুরেফিরে সেই তো গোলকধাঁধায় ফেরা।
ইসরাইলের উচ্ছেদ আদেশে প্রতিবারেই শহর ছেড়ে পালানোর হিড়িক পড়লেও এবার সেই আদেশ অমান্য করে নিজ বাড়িতেই থাকছেন গাজাবাসী। কারণ বর্বর সেনাদের নির্মম অত্যাচারে দৌড়াতে দৌড়াতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তারা। আদেশ না মানলে বোমার আঘাতে যেকোনো সময় ছিন্নভিন্ন হতে পারে দেহ। তবুও বাস্তুচ্যুত হওয়ার পরিবর্তে নিজের বাড়িতে থেকে ইসরাইলের আক্রমণের মুখোমুখি হওয়াকেই বেছে নিচ্ছেন গাজাবাসী। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে নতুন করে হারানোর আর ভয় নেই তাদের। আল-জাজিরা।
গাজায় যুদ্ধের দেড় বছর পর প্রায় ৭০ শতাংশ ভূখণ্ড এখন খালি করার নির্দেশে রয়েছে। ১৮ মার্চ থেকে গাজার বিভিন্ন শহরে কমপক্ষে চব্বিশটি বাস্তুচ্যুতির আদেশ জারি করেছে ইসরাইল। যার মধ্যে বেইত হানুন, বেইত লাহিয়া, গাজা সিটি, দেইর আল-বালাহ, আল-নুসাইরাত এবং খান ইউনিসও রয়েছে। ৩১ মার্চ ইসরাইল দক্ষিণতম প্রদেশ রাফাহতেও একটি আদেশ জারি করে।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে, শুধু ১৮ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিলের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তবে কয়েকটি অঞ্চলের বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুতির আদেশের পরও নিজ শহরেই থাকছেন। বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন তারা। ৪৩ বছর বয়সি পাবলিক স্কুলের শিক্ষক আদেল মুরাদ বলেছেন, ইসরাইলের তীব্র বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচতে তার পরিবারের ৯ সদস্যকে নিয়ে শুজাইয়া থেকে পশ্চিম আল-নাসরপাড়ায় পালিয়ে যান তিনি। কিন্তু জায়গার অভাবে তারা সেখানে বেশিক্ষণ থাকেননি। পরের দিনই ইসরাইলি আদেশ অমান্য করে বাড়িতে ফিরে আসেন তারা। মুরাদ বলেছেন, আমি বাস্তুচ্যুতিতে বিরক্ত, বাস্তুচ্যুতি হলো অপমান। কোথাও থাকার জায়গা নেই। আমাকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থাকতে হলেও আমি আর আমার বাড়ি ছেড়ে যাব না।
ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বাস্তুচ্যুতির আদেশ অমান্য করে ৪৮ বছর বয়সি মাহমুদ সারহানও তার ছয় সন্তানকে নিয়ে থাকছেন জেইতুন অঞ্চলে। তিনি বলেছেন, আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। আমি আমার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আর পালিয়ে যাব না।
ইসরাইলের পাশাপাশি গাজা খালি করার জন্য মরিয়া যুক্তরাষ্ট্রও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একের পর এক পরিকল্পনাও করেছে দেশটি। সম্প্রতি হামাসকে গাজা ছাড়ার লোভনীয় প্রস্তাবও দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। গোপনে গাজা ত্যাগ ও নিরস্ত্রীকরণের জন্য সংগঠনটিকে দুই বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দেয়। পরিবারসহ নিরাপদে দেশত্যাগের মতো সুবিধাও ছিল সেই প্রস্তাবে। তবে একবাক্যে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দেন হামাসের শীর্ষ নেতারা। এদিকে গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলা নিরলসভাবে চলছেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার জানিয়েছেন, ১৮ মার্চ থেকে ৯ এপ্রিলের মধ্যে বাস্তুচ্যুতদের আবাসিক ভবন এবং তাঁবুতে ইসরাইলি হামলার প্রায় ২২৪টি ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন অনেকেই। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। সোমবার পর্যন্ত গত এক ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৩৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইলি হামলায় ৫১ হাজার ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ১৬ হাজার ৯৩১ জন আহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৫ লাখ মানুষ।
সবুজদেশ/এসইউ