ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ২নং জামাল ও ৩নং কোলা ইউনিয়নের ২০ গ্রামের ১২৮ জন মানুষের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়েরের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার ২০ দিন পর কালীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) মোফাজ্জেল হোসেন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এই মামলা নথিভুক্ত করেছেন বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। জামাল ইউনিয়নের কাবিলপুর গ্রামে এক ব্যক্তির বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও এর প্রতিবাদ করায় তিন ব্যক্তিকে রক্তাক্ত জখমের অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। এমনকি এই মামলায় একই ব্যক্তিকে দুইবার আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই বিএনপির নেতাকর্মী বলে জানা গেছে।
এদিকে এ মামলার আলামত হিসেবে একটি পোড়া বাঁশের অংশের ছবি পেয়েছেন কালীগঞ্জ থানার তদন্ত ওসি মোফাজ্জেল হোসেন। মামলা রেকর্ড করার ব্যাপারে কালীগঞ্জ থানার ওসি তদন্ত মোফাজ্জেল হক বলেন, মামলাটি তিনি রেকর্ড করেন। এর একদিন পর তিনি সরজমিনে তদন্তে যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি অগ্নিকাণ্ডের কিছু আলামত পেয়েছি। পরে তিনি সাংবাদিকদের কয়েকটি ছবি পরিবেশন করেন।
ওসির প্রদান করা ছবিতে দেখা যায়, রান্না ঘরের চালের একটি বাঁশের কিছু অংশ পোড়া আছে। তাছাড়া রান্না ঘরের চাল কিংবা অন্য কোথাও আগুন লাগার কোন চিত্র দেখা যায় নি। এমনকি বাঁশটি পুড়লেও সেই তাপ অন্যত্রও লাগেনি। ঘটনার দিন ওই ইউনিয়নে কোন আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেনি বলে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
কাবিলপুর গ্রামের প্রায় ২০ জন স্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, গত ১ জুন নাকোবাড়িয়া এলাকায় একটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কিন্তু কাবিলপুর গ্রামের কোন বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি।
কালীগঞ্জ থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ জুন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম হাওলাদারকে হরিণাকুণ্ডু থানায় বদলি করা হয়। কালীগঞ্জ থানায় নথিভুক্ত মামলাটি ১৪ জুন দাখিল করেন বাদী আব্দুল লতিফ। মামলাটিতে ভিত্তিহীন একাধিক অভিযোগ ও আসামির নাম-ঠিকানায় গরমিল থাকায় সেসময় বাদীকে মামলার এজাহার সংশোধন করে পুনরায় এজাহার দাখিল করার কথা জানায় পুলিশ। কিন্তু পরবর্তীতে এজাহার সংশোধন করে দেননি মামলার বাদী। এরইমধ্যে ওসি বদলি হওয়ার সুযোগে ২১ জুন মামলাটি থানায় রেকর্ড করেন ওসি (তদন্ত) মোফাজ্জেল হোসেন।
এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১ জুন সকাল সাড়ে ছয়টায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আসামিরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাবিলপুর গ্রামে বাদীর বসতবাড়িতে যান। তারা বাড়িতে ঢুকে সাত লাখ টাকা মূল্যের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। তিন লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের দুইটি গরু ও ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের দুই ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ দুই লাখ টাকা নিয়ে যায়। একপর্যায়ে আসামিরা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে স্থানীয়দের সহায়তায় আগুন নিভানো সম্ভব হয়। এসময় অনেকে এসে প্রতিবাদ করলে খোর্দ তালিয়ান গ্রামের তিনজনকে হত্যা করার উদ্দেশে রক্তাক্ত জখম করে। মামলায় খোর্দ তালিয়ান গ্রামের ১২, দৌলতপুরের ২, দামোদরপুরের ২, খালকুলার ২, সড়াবাড়ীয়ার ৩, বড় তালিয়ানের ১১, তেঘরিহুদার ৩, বড় ডাউটির ৬, কাবিলপুরের ১১, উল্লার ১৯, মায়ধরপুরের ২, জয়নগরের ৫, খানজাপুরের ৬, রামচন্দ্রপুরের ৩, বাসুদেবপুরের ২, কামালহাটের ২, রাকড়ার ১, পারখালকুলার ১৭, নাটোপাড়ার ১৭ ও কাদিরডাঙ্গা গ্রামের একজনকে আসামি করা হয়েছে। ৩১ নম্বর আসামি তেঘরিহুদা গ্রামের মৃত জাকিরের ছেলেকে ৮৮ নম্বর আসামি হিসেবে দুইবার নাম লেখা হয়েছে।
কাবিলপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, হয়রানি ও মামলা বাণিজ্যের উদ্দেশে ১২৮ জনের নামসহ অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদীর বাড়িতে কোন অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনার কিছুদিন আগে তার বাড়িতে বিদ্যুতের শঠসার্কিট থেকে সামান্য আগুন লাগে। সেই ঘটনাকে মামলায় অগ্নিসংযোগ বলে দাবি করা হয়েছে। মামলাটি পুরোই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
তবে কাবিলপুর গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, ১ জুন ঘটনার দিন খোর্দ তালিয়ান গ্রামের যে তিনজন আহত হয়েছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে তারা ওইদিন ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে কাবিলপুর গ্রামে উপস্থিত ছিলেন না। তাদের বাড়ি তিন গ্রাম দূরে। এর মধ্যে বড় তালিয়ান, নাকোবাড়িয়া, খালকুলা গ্রাম রয়েছে। ওইদিন সকাল আটটার দিকে তালিয়ান গ্রামে শ্মশানঘাট দুপক্ষের সংঘর্ষে তারা আহত হয়েছেন। ওই সংঘর্ষে একপক্ষে অংশ নিয়ে হামলা করেছিলেন আহতরা।
তারা আরও জানান, ওইদিন সকালে আব্দুল লতিফের বাড়িতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি। আমরা সেদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাঁস-মুরগির ঘরে টিনে মাত্র দুটি কোপের দাগ দেখেছিলাম। এমনকি আসবাবপত্র ভাঙচুর, গরু ও স্বর্ণ লুটপাটের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেদিন সকালে বাড়ি থেকে অন্যত্র মালামাল সরানো হয়েছে।
এ মামলার বিষয়ে কালীগঞ্জ থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে যোগদানের (২২ জুন) আগের দিন মামলাটি রেকর্ড করা হয়েছে। মামলায় কোন মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেওয়া হলে পরবর্তীতে তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
সবুজদেশ/এসএএস