ঢাকা ০১:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কালীগঞ্জের যে গ্রামের মানুষের পাট আর পাটকাঠির উপরই সংসারের ভর

 

গ্রামের একপাশে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বেগবতী আর মাগুরা জেলার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া ফটকি নদীর মিলনস্থল। ফলে প্রতিবছরের বর্ষার মৌসুম আসলেই গ্রামবাসীকে পানির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্ত যে বছর বৃষ্টি কম হয় সে বছর কৃষকেরা ভালোভাবে তাদের ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারেন। আর বেশি হলে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে যায় তাদের ফসলী মাঠ। ফলে আমন মৌসুমে তাদের একমুঠো ধানও ঘরে ওঠে না। তখন সারাবছর তাদের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর দূর্বল পানি প্রবাহে প্রায় বছরই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। এভাবে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হয় গ্রামের প্রায় শতভাগ কৃষক। যে কারনে এখন আর তারা কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। বিগত দিনের ক্ষতির অভিজ্ঞতা থেকে প্রায় শতভাগ কৃষক আমন মৌসুমে ধানের বিকল্প পাটের চাষ করে থাকেন। তাছাড়াও পাটের দামও ভালো। পাটকাঠিও বিক্রি হয় বেশ চড়া দামে। তাইতো তাদের সংসার ভর করে পাট আর পাটকাঠির ওপর। এমন অবস্থা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের নাটোপাড়া গ্রামে।

গত সোমবার সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, পানি নামতে শুরু করলেও ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের নাটোপাড়া ও মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার চটকাবাড়িয়া ধাপোপাড়া, শ্রীবলতলা, মশাখালি, কোটভাগ, দেবিলাসহ চারপাশে গ্রামগুলোর মাঝখানের কমপক্ষে ২১ গ্রামের বিস্তর এলাকার মাঠ এখনও পানিতে একাকার হয়ে রয়েছে। বিস্তর এ মাঠের নাটোপাড়ার অংশে পানির কারনে কৃষকেরা সময় মত পাট কাটতে পারেন নি। তাই এ বছর বেশ বিলম্বে কৃষকেরা পঁচিয়েছেন। গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতভাগ কৃষক পরিবারে পাট ও পাটকাঠি ঘিরে ব্যস্ততা। অনেক সময় গড়িয়ে গেলেও এখনও অনেকে পঁচানো পাটের আঁশ ছুড়িয়ে ধোলায় করছেন। যেখানে গ্রামের নারী পুরুষেরা সমানে কাজ করছেন। তবে গ্রামজুড়েই পাট আর পাটকাঠি বসতবাড়ির সামনে অথবা পিচ সড়কের দুই পাশে সাজিয়ে রোদে শুকানোর দৃশ্য চোখে পড়েছে। যা দেখে মনে হচ্ছে সড়কের দুই ধার দর্শনীয় করতে পাট আর পাটকাঠি দিয়ে যেন বিশেষ ধরনের তোরন সাজানো হয়েছে।

নাটোপাড়া গ্রামের সাবুর আলী নামের এক কৃষক জানান,ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা ও মাগুরা জেলার সীমান্তবর্তী নাটোপাড়া গ্রামে তাদের বসবাস। গ্রামের একপাশে ঝিনাইদহের বেগবতী ও মাগুরা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ফটকি নদীর মিলনস্থল। তিনি বলেন ছোটবেলায় দেখেছেন দুটি নদীই গভীর ছিল। সে সময়ের বর্ষা মৌসুমে যতই পানি হোক না কেন তা নদী দিয়ে বের হয়ে যেতো। মাঠের একটু উচু জমিতে আমন ধানের চাষ হতো। কিন্ত কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ কমে গেছে।

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি সময়ে যে বছর একটু বেশি পানি হয় সে বছর নদীর পানি ফুলে ফেঁপে তাদের গ্রামসহ আশপাশের মাগুরা জেলার বেশ কিছু গ্রামের বিস্তর এলাকার মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বার বার আমন ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অভাবে পড়েন। সে কারনে এখন তাদের গ্রামের কৃষকেরা আর কোন ঝুঁকিতে যেতে রাজি নয়। তাই গ্রামের শতভাগ কৃষক এখন পানি সহিঞ্চু পাটচাষে ঝুঁকেছেন।

একই গ্রামের কৃষক সাবেক ইউপি সদস্য জামাত আলী জানান, তাদের গ্রামটির পূর্ব পাশে গ্রাম ঘেষা কিছু উচু জমি আছে সেখানে আমন ধানের চাষ হয়। তবে গ্রামের পূর্বপাশে বিশাল নিচু মাঠটির কৃষকেরা প্রায় বছরই পানির বিড়ম্বনায় পড়েন। সে সময়ে ফসলীক্ষেত ডুবে নষ্ট হয়। তাই তারা আর আমনের আশা করেন না। পাটচাষ করেন। আর এ সময় পানি থাকে বলে পাট পঁচানো ও ধোঁয়া নিয়ে কোন ভাবনা থাকে না তাদের। পাটের পঁচাতে (জাগ) আসতে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়। জাগ আসা পাট পানির মধ্য থেকে আঁশ ছাড়াতে এছাড়াও ভেজা পাট ও পাটকাঠি রোদে শুকাতে বাড়ি বাড়িতে কৃষক কৃষাণীদের ব্যস্ততার সীমা থাকে না। এ সময় গ্রামের দিনমজুর শ্রেণীর নারী পুরুষেরা প্রতি মুঠো পাট ৫/৬ টাকা দরে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ধোঁলায় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ শত টাকা রোজগার করে থাকেন।

কৃষক আতাউর রহমান জানান, এখন গ্রামের অধিকাংশ কৃষকই পাট ঘরে তুলে ফেলেছেন। বাকিগুলোও খুব শীঘ্রই উঠে যাবে। প্রতি বর্ষায় তাদের গ্রামে কাঁদা পানির মধ্যে পাট নিয়ে বাড়ি বাড়িতে আলাদা ধরনের ব্যস্ততা থাকে। কেননা গ্রামের শতভাগ কৃষক পাটচাষ করে থাকেন। যা সারাদেশের মধ্যে আর কোন গ্রামে এমনটি আছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন,ব্যবসায়ীরা গ্রাম থেকে পাট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর দামও ভালো। পাটকাঠিও একইভাবে বিক্রি হচ্ছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, চলতি মৌসুমে এ উপজেলাতে মোট ৭ শত ১০ হেক্টোর পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এরমধ্যে চাষ হয়েছে ৬শ ৬৫ হেক্টোর জমিতে। এক সময়ে বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে পাটের রেকর্ড পরিমানে চাষ হতো। নানাবিধ কারনে এখন কমে গেছে। তিনি বলেন, ভালো পাট হলে এক বিঘা জমিতে কমপক্ষে ১৫ মন পাট উৎপাদন হয়। প্রতিমন পাট এখন ৩২ থেকে ৩৮শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও এক বিঘা জমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকার পাটকাঠি বিক্রি হচ্ছে। কাজেই পাটচাষ বেশ লাভজনক।

তিনি বলেন, এ উপজেলার নাটোপাড়া গ্রামটির প্রায় শতভাগ কৃষক পাটচাষ করে সোনালী আাঁশের সোনালী দিনের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

সবুজদেশ/এসএইচ/এসএএস

Tag :

কালীগঞ্জের যে গ্রামের মানুষের পাট আর পাটকাঠির উপরই সংসারের ভর

Update Time : ০৬:২৪:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

 

গ্রামের একপাশে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বেগবতী আর মাগুরা জেলার মধ্যদিয়ে বয়ে যাওয়া ফটকি নদীর মিলনস্থল। ফলে প্রতিবছরের বর্ষার মৌসুম আসলেই গ্রামবাসীকে পানির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্ত যে বছর বৃষ্টি কম হয় সে বছর কৃষকেরা ভালোভাবে তাদের ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারেন। আর বেশি হলে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ডুবে যায় তাদের ফসলী মাঠ। ফলে আমন মৌসুমে তাদের একমুঠো ধানও ঘরে ওঠে না। তখন সারাবছর তাদের অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর দূর্বল পানি প্রবাহে প্রায় বছরই এমন ঘটনা ঘটে থাকে। এভাবে বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হয় গ্রামের প্রায় শতভাগ কৃষক। যে কারনে এখন আর তারা কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে চান না। বিগত দিনের ক্ষতির অভিজ্ঞতা থেকে প্রায় শতভাগ কৃষক আমন মৌসুমে ধানের বিকল্প পাটের চাষ করে থাকেন। তাছাড়াও পাটের দামও ভালো। পাটকাঠিও বিক্রি হয় বেশ চড়া দামে। তাইতো তাদের সংসার ভর করে পাট আর পাটকাঠির ওপর। এমন অবস্থা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার জামাল ইউনিয়নের নাটোপাড়া গ্রামে।

গত সোমবার সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, পানি নামতে শুরু করলেও ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের নাটোপাড়া ও মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার চটকাবাড়িয়া ধাপোপাড়া, শ্রীবলতলা, মশাখালি, কোটভাগ, দেবিলাসহ চারপাশে গ্রামগুলোর মাঝখানের কমপক্ষে ২১ গ্রামের বিস্তর এলাকার মাঠ এখনও পানিতে একাকার হয়ে রয়েছে। বিস্তর এ মাঠের নাটোপাড়ার অংশে পানির কারনে কৃষকেরা সময় মত পাট কাটতে পারেন নি। তাই এ বছর বেশ বিলম্বে কৃষকেরা পঁচিয়েছেন। গ্রামটি ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতভাগ কৃষক পরিবারে পাট ও পাটকাঠি ঘিরে ব্যস্ততা। অনেক সময় গড়িয়ে গেলেও এখনও অনেকে পঁচানো পাটের আঁশ ছুড়িয়ে ধোলায় করছেন। যেখানে গ্রামের নারী পুরুষেরা সমানে কাজ করছেন। তবে গ্রামজুড়েই পাট আর পাটকাঠি বসতবাড়ির সামনে অথবা পিচ সড়কের দুই পাশে সাজিয়ে রোদে শুকানোর দৃশ্য চোখে পড়েছে। যা দেখে মনে হচ্ছে সড়কের দুই ধার দর্শনীয় করতে পাট আর পাটকাঠি দিয়ে যেন বিশেষ ধরনের তোরন সাজানো হয়েছে।

নাটোপাড়া গ্রামের সাবুর আলী নামের এক কৃষক জানান,ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা ও মাগুরা জেলার সীমান্তবর্তী নাটোপাড়া গ্রামে তাদের বসবাস। গ্রামের একপাশে ঝিনাইদহের বেগবতী ও মাগুরা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ফটকি নদীর মিলনস্থল। তিনি বলেন ছোটবেলায় দেখেছেন দুটি নদীই গভীর ছিল। সে সময়ের বর্ষা মৌসুমে যতই পানি হোক না কেন তা নদী দিয়ে বের হয়ে যেতো। মাঠের একটু উচু জমিতে আমন ধানের চাষ হতো। কিন্ত কালক্রমে নদী ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ কমে গেছে।

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি সময়ে যে বছর একটু বেশি পানি হয় সে বছর নদীর পানি ফুলে ফেঁপে তাদের গ্রামসহ আশপাশের মাগুরা জেলার বেশ কিছু গ্রামের বিস্তর এলাকার মাঠ পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বার বার আমন ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে অভাবে পড়েন। সে কারনে এখন তাদের গ্রামের কৃষকেরা আর কোন ঝুঁকিতে যেতে রাজি নয়। তাই গ্রামের শতভাগ কৃষক এখন পানি সহিঞ্চু পাটচাষে ঝুঁকেছেন।

একই গ্রামের কৃষক সাবেক ইউপি সদস্য জামাত আলী জানান, তাদের গ্রামটির পূর্ব পাশে গ্রাম ঘেষা কিছু উচু জমি আছে সেখানে আমন ধানের চাষ হয়। তবে গ্রামের পূর্বপাশে বিশাল নিচু মাঠটির কৃষকেরা প্রায় বছরই পানির বিড়ম্বনায় পড়েন। সে সময়ে ফসলীক্ষেত ডুবে নষ্ট হয়। তাই তারা আর আমনের আশা করেন না। পাটচাষ করেন। আর এ সময় পানি থাকে বলে পাট পঁচানো ও ধোঁয়া নিয়ে কোন ভাবনা থাকে না তাদের। পাটের পঁচাতে (জাগ) আসতে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়। জাগ আসা পাট পানির মধ্য থেকে আঁশ ছাড়াতে এছাড়াও ভেজা পাট ও পাটকাঠি রোদে শুকাতে বাড়ি বাড়িতে কৃষক কৃষাণীদের ব্যস্ততার সীমা থাকে না। এ সময় গ্রামের দিনমজুর শ্রেণীর নারী পুরুষেরা প্রতি মুঠো পাট ৫/৬ টাকা দরে পাটের আঁশ ছাড়িয়ে ধোঁলায় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ শত টাকা রোজগার করে থাকেন।

কৃষক আতাউর রহমান জানান, এখন গ্রামের অধিকাংশ কৃষকই পাট ঘরে তুলে ফেলেছেন। বাকিগুলোও খুব শীঘ্রই উঠে যাবে। প্রতি বর্ষায় তাদের গ্রামে কাঁদা পানির মধ্যে পাট নিয়ে বাড়ি বাড়িতে আলাদা ধরনের ব্যস্ততা থাকে। কেননা গ্রামের শতভাগ কৃষক পাটচাষ করে থাকেন। যা সারাদেশের মধ্যে আর কোন গ্রামে এমনটি আছে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন,ব্যবসায়ীরা গ্রাম থেকে পাট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ বছর দামও ভালো। পাটকাঠিও একইভাবে বিক্রি হচ্ছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষিকর্মকর্তা মাহাবুব আলম রনি জানান, চলতি মৌসুমে এ উপজেলাতে মোট ৭ শত ১০ হেক্টোর পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এরমধ্যে চাষ হয়েছে ৬শ ৬৫ হেক্টোর জমিতে। এক সময়ে বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে পাটের রেকর্ড পরিমানে চাষ হতো। নানাবিধ কারনে এখন কমে গেছে। তিনি বলেন, ভালো পাট হলে এক বিঘা জমিতে কমপক্ষে ১৫ মন পাট উৎপাদন হয়। প্রতিমন পাট এখন ৩২ থেকে ৩৮শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও এক বিঘা জমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকার পাটকাঠি বিক্রি হচ্ছে। কাজেই পাটচাষ বেশ লাভজনক।

তিনি বলেন, এ উপজেলার নাটোপাড়া গ্রামটির প্রায় শতভাগ কৃষক পাটচাষ করে সোনালী আাঁশের সোনালী দিনের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

সবুজদেশ/এসএইচ/এসএএস