ফারুক নোমানী:

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে যেমন আছে ইবাদত বা উপাসনার নানা বিধান, একইভাবে ইসলামে রয়েছে মানুষের বৈধভাবে জীবিকা উপার্জনেরও গুরুত্ব। এমনকি ইসলামে হালাল পন্থায় জীবিকার চেষ্টা করাকেও অন্যতম একটি ফরয ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। নবীজী সা. বলেছেন-‘অন্যান্য ফরয বিধান পালনের সাথে সাথে হালালভাবে রোযগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরয।’ (শুয়াবুল ঈমান: ৮৩৬৭)

ইসলাম মানুষকে পরনির্ভর জীবনযাপনের নির্দেশ দেয়নি। এ নির্দেশও দেয়নি যে, মানুষ বৈধ পন্থায় জীবিকা উপার্জন ছেড়ে সব সময় মসজিদে পড়ে থাকবে। মূলত মহাবিশ্বের মহান স্রষ্টা যেমন মানুষের আধ্যাতিক উন্নয়নের জন্য ইবাদতের বিধান দিয়েছেন, একইভাবে তার জীবিকার জন্যও নামায শেষান্তেই জমিনে ছড়িয়ে পড়তে বলেছেন। আল্লাহ বলেন-‘নামায সমাপ্ত হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যেন তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সূরা জুমআ: ১০) এ আয়াতে আল্লাহ বলতে চেয়েছেন-‘যখন নামাজ শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেরিয়ে পড়।’ তাই রিজিকের সন্ধান করা, স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী হওয়া নিশ্চয়ই দুনিয়াদারি নয়, নয় ঐচ্ছিকও বরং তা একান্তই ফরয একটি ইবাদত। যারা এ ফরয পালনে কর্মের পথ অবলম্বন করে সন্ধ্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন। একটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শ্রমের কারণে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যা যাপন করে সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।’ (তাবারানি; ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃষ্ঠা-২)। হালাল উপার্জনের জন্য বের হওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করা যায়। তাই তো মহানবী সা. হালাল উপার্জনের জন্য বের হওয়া লোকটির জন্য আল্লাহর পথে জিহাদে থাকা লোকের সমান সওয়াবের ঘোষণা করেছেন। বিখ্যাত সাহাবী হযরত কাব ইবনে আজুরা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রসুলুল্লাহ সা.-এর কাছ দিয়ে এক লোক যাচ্ছিল। সাহাবায়ে কিরাম লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য দেখে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) থাকত! নবী সা. বললেন- ‘লোকটি যদি তার বৃদ্ধ পিতামাতা অথবা ছোট ছোট সন্তানের জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায়ই আছে’ (অর্থাৎ হাত না পেতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করলে সে জিহাদের সওয়াবই পাবে)। (হাইসামি : ৪/৩২৫)।

আমরা ইসলামের সৌন্দর্য ও সার্বজনীনতা অনুধাবন করতে পারি না। হাতে গোনা গুটিকতেক ইবদতকেই আমরা পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মনে করি। অথচ অর্থনীতি, সমাজনীতিও ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সর্বকালের সেরা অর্থনীতিবিদ নবীজী সা. ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণে নিরলস চেষ্টা করেছেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই গ্রহণ করেছেন নানা উদ্যোগ। ব্যক্তিগত জীবনে স্বনির্ভরতার জন্য প্রত্যেককে উদ্যোগী হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। আবার যারা আয়-রোজগারে অক্ষম তাদের দেখভালের দায়িত্বও দিয়েছেন সচ্ছলদের ওপর। নবীজী সা. উম্মতকে হালালভাবে উপার্জনের নির্দেশ যেমন দিয়েছেন। তেমনি আবার উপার্জিত অর্থ সংসারে ব্যয় করাকে অন্যতম ইবাদত বলেও আখ্যা দিয়েছেন। এ সম্পর্কেই তিনি বলেছেন-‘মানুষের সর্বোত্তম মুদ্রা সেটি, যা সে তার পরিবারের খরচে ব্যয় করে।’ (মুসলিম: ৯৯৪) অন্য একটি হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা.বলেন- ‘কোনো ব্যক্তি তার পরিবারে যে খরচ করে তা-ও সদকাস্বরূপ, অর্থাৎ এতেও সে সদকার সওয়াব পাবে। ’ (বুখারি : ৪০০৬)

নিজ হাতে উপার্জনই ইসলামের মহান শিক্ষা। হযরত রাফে ইবনে খাদিজ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সা.কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন- ‘ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্ধ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’ (মুসনাদে আহমাদ)। অন্য হাদীসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সা. বলেন- ‘তোমাদের কারও নিজ পিঠে কাঠের বোঝা বয়ে এনে বিক্রি করা কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে উত্তম। তাকে (প্রার্থীকে) সে কিছু দিক বা না দিক।’ (বুখারি, মুসলিম)।

পাঠক, নবীজী সা. এর এসকল হাদীস দ্বারা আমরা জানতে পারি, ইসলামে কর্মের গুরুত্ব কত বেশি। ইসলাম কখনোই কর্মকে ছোট করে দেখেনি। সমাজের চোখে যতই ছোট হোক না কেন প্রতিটি বৈধ উপার্জনই ইসলামে মহান ও ইবাদতের। এ শিক্ষা মহানবী সা. এর। কিশোর বয়সেও তিনি বেকার বসে থেকে চাচার সংসারে বোঝা হননি। কৈশোরে চরিয়েছেন মেষ, যৌবনে ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। দেশ থেকে দেশান্তর সফর করে অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও রেখেছেন সফল ব্যবসায়ীর বিরল কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তাঁর চারজন খলিফার প্রত্যেকেই ব্যবসা করতেন। কাপড়ের ব্যবসা করে বিত্তশালী হয়েছিলেন হযরত আবুবকর (রা.)। ইসলাম গ্রহণকালে তিনি ৪০ হাজার স্বর্ণমূদ্রার মালিক ছিলেন। হযরত উমর (রা.)-এরও জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা। খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য তিনি ব্যবসা করতেন। হযরত ওসমান (রা.) সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। যৌবনের শুরুতেই নিজেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত করেন। তৎকালীন আরবের বড় ধনী ছিলেন বলেই তাকে ‘গনি’ বলা হতো। নবীজী সা. যাঁদেরকে দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন সেই দশজন সাহাবীও ছিলেন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। ইমাম আবু হানিফাও (রহ.) ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। রাষ্ট্রীয় হাদিয়া-তোহফার পরোয়া না করে নিজ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ, জ্ঞানের সেবা এবং গরিব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। তার পিতার ছিল ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও হেজাজজুড়ে বিস্তৃত এলাকায় রেশমি কাপড়ের ব্যবসা। কৈশোরেই তিনি পিতার ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়াও ইসলামে মহামানব হিসেবে যারা বরিত ও চিরস্মরণীয় তাঁদের অধিকাংশের পেশা ছিলো ব্যবসা। জ্ঞানের চর্চা ও ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি তাঁরা সংসারের ব্যয় বহনের জন্য ব্যবসা বা অন্য কোন পেশা গ্রহণ করেছিলেন। পরমুখাপেক্ষী জীবন ছিলো তাঁদের কাছে বড়ই নিন্দনীয়।

সম্প্রতিকালে আমাদের শিক্ষিত যুবকদের একটি মানসিকতা হয়ে গেছে যে, আমরা বেকারত্ব নিয়ে বৃদ্ধ বাবার কাঁধের বোঝা হয়ে থাকতে চাই, তবুও নিজে উপার্জনের জন্য কোন পথ খুঁজি না। আবার ধর্মীয় ও সাধারণ সকল অঙ্গনের শিক্ষার্থীদের মাঝে এ বিশ^াস চরমভাবে চেপে বসেছে, আমরা লেখাপড়া শিখছি অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু চিন্তাটি কি আদৌ ঠিক? লেখাপড়া বা জ্ঞানার্জন তো ব্যক্তিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য। যে জ্ঞান দেশ ও দশের কল্যাণে ব্যয় হবে। জাতিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিবে। তাকে রুটিরুজির একমাত্র মাধ্যম বানানো কখনোই উচিত নয়। এজন্যই যখন একজন শিক্ষক পাঠদানের পাশাপাশি অন্য ছোট একটি ব্যবসা নিয়ে বসেন, তখন মানুষ তাকে বাঁকা চোখে দেখে। একজন শিক্ষার্থী যদি লেখাপড়ার পাশাপাশি উপার্জনের কোন বৈধ পথ অবলম্বন করে বন্ধুদের কাছে অনেক সময় তাকে বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। আমাদের চোখে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, কালোবাজারি চক্ষু লজ্জার নয়,বরং বৈধভাবে সংসারের আয়ের জন্য ক্ষুদ্র কোন কাজ করলেই মানুষ এটাকে নিয়ে নানাভাবে ঠাট্টাবিদ্রুপ করে। যা আমাদের জাতীয় জীবনে চরম দুর্গতি সৃষ্টি করছে।

তাই আসুন, পরনির্ভর না হয়ে, প্রত্যেকেই বৈধ পথে আয়ের চেষ্টা করি। এটাই ইসলামের শিক্ষা। নবীজীর আদর্শ এটাই। আর এর মাধ্যমেই আমাদের দেশের জনসংখ্যা জনশক্তিতে পরিণত হবার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক: মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here