ফারুক নোমানীঃ

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামে যেমন আছে ইবাদত বা উপাসনার নানা বিধান, একইভাবে ইসলামে রয়েছে মানুষের বৈধভাবে জীবিকা উপার্জনেরও গুরুত্ব। এমনকি ইসলামে হালাল পন্থায় জীবিকার চেষ্টা করাকেও অন্যতম একটি ফরয হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। নবীজী সা. বলেছেন-‘অন্যান্য ফরয বিধান পালনের সাথে সাথে হালালভাবে রোযগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরয ।’ (শুয়াবুল ঈমান: ৮৩৬৭) ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। সমাজের একটি বড় অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। নবীজী সা. নিজেই ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তাঁর চারজন খলিফার প্রত্যেকেই ব্যবসা করতেন। যাঁদেরকে তিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন সেই দশজন সাহাবীও ছিলেন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত। তাই ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও নবীজী সা. সততাবান ব্যবসায়ীদের জন্য সুসংবাদও দিয়েছেন।

সঙ্গত কারণেই ইসলাম ব্যবসায় কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করেছে। যা অনুসরণ করলে ক্রেতা-বিক্রেতার প্রত্যেকেই হবে লাভবান। পুরো বাজার থাকবে নিয়ন্ত্রিত। বেচাকেনায় ঠকবে না কোন পক্ষই।

ব্যবসার সব চেয়ে বড় মূলনীতি হলো এই হাদীসটি। নবীজী বলেন-প্রকৃত মুসলিম সেই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদে থাকে। (বুখারী: ১০) প্রকৃত মুসলিম কখনোই কোনভাবে অর্থের লোভে অন্যকে প্রতারিত করে না, ঠকায় না। তার কথা ও ব্যবহারে অন্য মানুষ নিরাপদে থাকে। বাজার মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার বড় একটি কারণ নবীজীর এ শিক্ষার অনুসরণ না করা।

১. ব্যবসায় সততা: সততা ব্যবসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সততা বিদ্যমান থাকলে বাজার থাকবে শান্ত, তৈরি হবে না কৃত্রিম সংকট এবং ক্রেতারাও হবে না প্রতারণার শিকার। তাই নবীজী সা. সততা বজায় রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেছেন-‘সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবী, সত্যবাদী ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি : ১২০৯)

২. পণ্য বিক্রি করেত মিথ্যা শপথ করা : ক্রেতাকে আশ্বস্ত করার জন্য মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয় করা কোনোভাবেই সততার মধ্যে পড়ে না। মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারীর পরকালীন পরিণতি ভয়াবহ। নবীজী সা. বলেন- ‘আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির লোকের সঙ্গে কথা বলবেন না, তাদের দিকে তাকাবেনও না এবং তাদের পবিত্র করবেন না। বরং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি। (বলা হলো) তারা কারা, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বলেন, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রয়কারী।’ (মুসলিম, হাদিস : ৩০৬)

৩. পণ্যের ত্রুটি থাকলে তা প্রকাশ করা: পণ্য ক্রেতার সামনে খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করা বিক্রেতার দায়িত্ব। পণ্যের ছেঁড়া বা পচা অংশ না দেখিয়ে অথবা ভালোটি দেখিয়ে তার সঙ্গে খারাপগুলোও সরবরাহ করা নিশ্চিত প্রতারণা। নবী সা. বলেন- ‘যে ব্যক্তি পণ্যের ত্রæটি বর্ণনা না করে (বরং গোপন করে) বিক্রয় করে, সে সর্বদা আল্লাহর গজবের মধ্যে থাকে এবং ফেরেশতারা সব সময় তাকে অভিশাপ করতে থাকে। (ইবনে মাজাহ: ২২৪৭)

৪. প্রতারণা করে বিক্রি না করা : ব্যবসায় আমানতদারির একটি অন্যতম দিক হলো কথা-কাজে মিল থাকা। পণ্যের যেমন মান বলা হবে, বাস্তবেও তেমন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে হেরফের প্রতারণার শামিল। একদা রাসুল সা. খাদ্যশস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন, ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক! একি ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টির পানি পড়েছে। তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপর রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। যে ধোঁকাবাজি করে সে আমার দলভুক্ত নয়। (মুসলিম: ২৯৫)

৫. সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করা : পণ্যের পরিমাপে কমবেশি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সঠিক ওজন বা পরিমাপ নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘মন্দ পরিণাম তাদের যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য মাপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’
(সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩)

৬. বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করা : অনেক সময় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর মজুদদারির কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এতে কিছু ব্যবসায়ী সাময়িক লাভবান হলেও মহামারি ও দারিদ্র্যের পথ খুলে যায়। নবীজী সা. বলেন- ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫৫)

পাঠক, এগুলো ইসলামে ব্যবসার প্রাথমিক মূলনীতি। এ মূলনীতির অনুসরণে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই হবে লাভবান । প্রতারণার জাল থেকে রক্ষা পাবে জনসাধারণ। দেশ হবে সমৃদ্ধ।

লেখক: মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ।
ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here