ঢাকা ০৫:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছোটদের সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (১ম পর্ব)

Reporter Name

ফারুক নোমানীঃ

(প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের স্পন্দন, প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোট ৬৩ বছর জীবন পেয়েছিলেন। তিনি আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তাঁর জীবনের ৫৩ টি বছর কেটেছে। তার মধ্যে ৪০ বছর নবুওয়াতের আগে ও ১৩ বছর ছিল নবুওয়াতের পরে। এরপর মদীনাতে হিজরত করে জীবনের বাকি ১০টি বছর সেখানে কাটিয়ে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।)

নবীজী সা. এর মক্কী জীবন
(শৈশব থেকে নবুওয়াত পর্যন্ত)

জন্ম: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বর্ষের (যে বছর ইয়েমেনের শাসক আবরাহা হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান চালিয়েছিল) রবিউল আওয়াল মাসের সোমবারে সুবহে সাদিকের সময় হয়েছে এ মর্মে ইতিহাসবিদগণ একমত। তবে তারিখের বিষয়ে অনেকগুলো মত বর্ণিত আছে। তার মধ্যে ১২ তারিখ প্রশিদ্ধ হলেও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে ৯ই রবিউল আওয়াল জন্ম তারিখ হয়। খৃস্টীয় হিসেব মোতাবেক ২০ এপ্রিল ৫৭১। (আল্লামা শিবলী নোমানী : সীরাতুন নবী পৃ. ৬১, সুলাইমান মানসুরপুরী : রহমাতুল্লিল আলামিন ১/৪০, )

নাম ও বংশ পরিচয়: তাঁর নাম মুহাম্মাদ। দাদা আবদুল মুত্তালিবই এ নাম রেখেছিলেন। তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ ও মায়ের নাম আমেনা। দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব ও দাদির নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব আর নানির নাম বাররাহ। দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন বনু হাশেম গোত্রের সরদার আর নানা ওয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার। এ দুইটি গোত্রই কুরায়েশ বংশের সম্ভ্রান্ত ও প্রশিদ্ধ গোত্র ছিল। পিতা আবদুল্লাহ ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মায়ের গর্ভে ছিলেন।

দুধ পান ও লালন-পালন: জন্মগ্রহণের পর সর্বপ্রথম তিনি তাঁর মা আমেনার দুধ পান করেন। কিছুদিন পর চাচা আবু লাহাবের দাসী সুওয়াইবা তাঁকে দুধ পান করান। এরপর হালিমা সাদিয়া তাঁকে নিয়মিত দুধ পান করান। তৎকালীন আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের রীতি অনুযায়ী শিশু মুহাম্মাদকেও শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উম্মুক্ত পরিবেশে লালন-পালনের জন্য পাঠানো হয়। যা শিশুদেরকে রোগবালই থেকে মুক্ত রাখত ও সুস্থ সবল করে তুলত। বিশেষ করে এতে তারা বিশুদ্ধ আরবিভাষায় অভ্যস্থ হয়ে উঠত। তিনি হালিমা সাদিয়ার বাড়িতে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত থাকেন।

বক্ষ বিদারণ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বমোট চারবার বক্ষ বিদারণ করা হয়েছে। প্রথমবার শৈশবে। যখন তিনি হালিমা সাদিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকতেন। সে সময় তার বয়স হয়েছিল চার বছর। ফিরিশতা জিবরাইল আ. এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে গিয়ে বুক চিরে কলিজা বের করে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন। এরপর যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে দিয়ে বলেন-‘এটি তোমার মধ্যকার শয়তানের অংশ’।
দ্বিতীয় বার বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটেছিল তাঁর ১০ বছর বয়সে। (ইবনু হিশাম) তৃতীয়বার এ ঘটনা নবুওয়াতের প্রাক্কালে সংঘটিত হয়। আর চতুর্থবার ঘটেছিল মিরাজের সময় ।

মা ও দাদার ইন্তেকাল: নবীজীর জন্মের পূর্বেই পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছিলেন। তার বয়স যখন ছয় বছর তখন মা আমেনা স্বামীর কবর যিয়ারতের উদ্দেশে পুত্র মুহাম্মাদ ও দাসী উম্মে আয়মানকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার উত্তরে মদীনার উদ্দেশে রওনা হন। মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জা’দীর পারিবারিক কবরস্থানে যিয়ারত শেষে একমাস বিশ্রামের পর আবার মক্কার পথে রওনা হন। কিছু দূর এলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবওয়া নামক স্থানে তাঁর মৃত্যু হয়। যা বর্তমানে মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর। পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতিম বালক মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আবদুল মুত্তালিবের স্নেহ ছায়ায়। কিন্তু এই ছায়াও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর তখন তার দাদা আবদুল মুত্তালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। দাদার অসিয়ত অনুযায়ী চাচা আবু তালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর তিনি ভাতিজা মুহাম্মদের যোগ্য অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সিরিয়ার প্রথম সফর: ১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসার উদ্দেশে তিনি শাম বা সিরিয়ায় সফর করেন। কাফেলা যখন বসরা শহরের নিকটে পৌঁছল, তখন এক খৃস্টান পাদ্রী যার মূল নাম ছিল জারজীস আর প্রসিদ্ধ ছিলেন বাহীরা নামে তার সাথে সাক্ষাৎ হল। বাহীরা ১২ বছরের কিশোর মুহাম্মাদকে দেখে বললেন-‘ইনিই সেই বিশ্বনেতা, ইনিই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসুল। যাকে আল্লাহ সারা পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন।’ লোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে, সে প্রতিশ্রুত সেই শেষ নবী? তিনি বললেন, যখন তোমরা পাহাড় থেকে নামছিলে তখন পথের পাশের গাছপালা, তরুলতা প্রস্তরখ- তার প্রতি সম্মানার্থে মাথা অবনত করছিল। এসব বস্তু কেবল নবীদেরকেই এভাবে সম্মান জানায়। পাদ্রী বাহীরা বললেন, তোমরা কখনোই তাকে রোমের দিকে নিয়ে যাবে না। রোমবাসী তাকে দেখলে তার গুণাবলী ও লক্ষণসমূহ দেখে চিনে ফেলবে এবং তাকে হত্যা করবে। চাচা আবু তালিবকে ইহুদীদের বিষয়ে সতর্ক করলে তিনি তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান।

ফুজ্জার যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ: ইসলামপূর্ব আরবে যুগ যুগ ধরে যে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছিল তার মধ্যে হরবুল ফুজ্জার বা ফুজ্জার যুদ্ধ অন্যতম। কুরায়েশ ও বনু কায়েস গোত্রের মাঝে সংঘটিত এই যুদ্ধে বুন কায়েস কুরায়েশদের ওপর বিজয় লাভ করে। পরে কুরায়েশরা বুন কায়েসের ওপর বিজয়ী হয়। সবশেষে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

যেহেতু কুরায়েশ বংশের লোকজন ন্যায়সঙ্গত কারণে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং এর সঙ্গে বংশের মানমর্যাদার প্রশ্ন জড়িত ছিল, সেজন্য নবীজী নিজেও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি কাউকে আক্রমণ করেননি। আল্লামা সুহাইলী বলেন-‘তিনি নিজে এ যুদ্ধে (সক্রিয়ভাবে ) যুদ্ধ করেননি যদিও যুদ্ধ করার মত বয়স তখন তার ছিল। এর কারণ, প্রথমত এটি হারাম মাসে সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত উভয় পক্ষই ছিল কাফের। তৃতীয়ত কেবল আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্যই নবীজীকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যে মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ কারা হারাম ছিল সে মাসে যুদ্ধটি হওয়ায় একে হরবুল ফুজ্জার বা পাপীদের যুদ্ধ বলা হয়।

হিলফুল ফুযুল: আরবের ধারাবাহিক নানা যুদ্ধে যে ভয়বহ পরিণতি হয়েছিল তা কারো কাছেই অস্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে ফুজ্জার যুদ্ধের ভয়াবহতা তো নবীজী সা. নিজচোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যা তাকে চরমভাবে ব্যথিত করেছিল। তাই এ সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধানের চিন্তা তাকে তাড়া করে ফিরছিল। তাছাড়া আরো একটি ঘটনা সে সময় ঘটেছিল। যুবায়েদ গোত্রের এক ব্যবসায়ী মাক্কার অন্যতম নেতা আস ইবন ওয়ায়েলের কাছে পণ্য বিক্রি করেন। পণ্য বুঝে নিয়ে আস আর তাকে মূল্য পরিশোধ করে না। ব্যবসায়ী লোকটি সাহায্যের জন্য অন্য সব নেতাদের কাছে যান, কিন্তু তারাও তাকে কোনভাবে সাহায্য করে না। ফলে সে আবু কোবায়েস পাহাড়ে উঠে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করে। যা শুনে নবীজীর চাচা যুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিব তা সমাধানের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আবদুল্লাহ বিন জুদআন তাইমির বাড়িতে গোষ্ঠীর প্রধানদেরকে নিয়ে জরুরী বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে নবীজীর দাদা ও নানার গোষ্ঠীসহ পাঁচটি গোষ্ঠী যোগদান করে। উক্ত বৈঠকে নবীজী ৪টি প্রস্তাব করেন আর চাচা যুবায়েরের সমর্থনে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

১. আমরা সমাজ থেকে অশান্তি দূর করব ২. মুসাফিরদের হেফাযত করব ৩. দুর্বল ও গরিবদের সাহায্য করব এবং ৪. অত্যাচারীদেরকে প্রতিহত করব। হরবুল ফুজ্জারের পরে যুলকাদাহর হারাম মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর তারা আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট গিয়ে উক্ত মযলুম ব্যবসায়ীর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন।

সফল ব্যবসায়ী তরুণ মুহাম্মাদ : ব্যবসায়ের উদ্দেশে ১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার উদ্দেশে বের হলেও পাদ্রী বাহীরার কথা শুনে চাচা আবু তালিব তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান। মক্কায় অনেক বিত্তশালী ছিলেন যারা সরাসরি নিজে ব্যবসা না করে নির্দিষ্ট চুক্তিতে বিশ্বস্ত লোকের কাছে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন । মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদুষী নারী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদও ছিলেন এমন একজন ব্যবসায়ী। তরুণ মুহাম্মাদের সততা আামানতদারি ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে অন্যদের তুলনায় অধিক মুনাফা দেবার প্রতিশ্রুতিতে ব্যবসায়ের প্রস্তাব কররেন। চাচা আবু তালিবের পরামর্শে তিনি তা গ্রহণ করলেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি খাদিজার মাল নিয়ে ব্যবসায়ের জন্য সিরিয়ায় যান। এই ব্যবসায় এত বেশি লাভ হয়েছে যা খাদিজা অন্য কারো কাছ থেকে কখনো পাননি।

খাদিজার সাথে বিবাহ: খাদিজা ছিলেন বিধবা নারী। পরপর তার দুইজন স্বামী মারা যাওয়ায় আরবের নেতৃস্থানীয় অনেকে তার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। নবীজীর সাথে সিরিয়া সফরে খাদিজা তার বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে পাঠান। মায়সারার কাছে নবীজীর মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি এবং উন্নত রুচিবোধের কথা শুনে তার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন । তিনি তার পরিবারের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। সিরিয়া থেকে ফিরে আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় উভয় পক্ষের মুরব্বীদের সম্মতিক্রমে তাদের বিবাহ হয়। এই বিয়ের মোহরানা ছিল ২০ টি উট। বিবাহের সময় খাদিজার বয়স ছিল ৪০ ও নবীজীর বয়স ছিল ২৫ বছর। তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল ২৫ বছর। নবীজীর ৩ পুত্র ও ৪ কন্যার ভেতর ইবরাহীম ব্যতীত ৬ সন্তানের সকলেই ছিল খাদিজার গর্ভজাত। তিনি তার প্রথম স্ত্রী, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি অন্য কাউকে বিবাহ করেননি।

কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণে আল-আমিন মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা: কাবা অর্থ চার দেয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কাবার দেওয়াল দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইবরাহীম ও ইসমাইল আ. এর হাতে নির্মিত আড়াই হাজার বছরের এই পবিত্র গৃহ সংস্কার ও পুনর্নিমাণের প্রয়োজন একান্ত আবশ্যক ছিল। ইবরাহীম আ. এর নির্মাণে কাবা ছিল ৯ হাত উচু চার দেয়াল বিশিষ্ট ঘর। কোন ছাদ ছিল না। কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিল যে, কাবার পুননির্মাণের কাজে সকল গোত্র শরিক থাকবে, তবে তাতে কারো কোন হারামা মাল ব্যয় করা যাবে না। বাকুম নামক জনৈক রোমান কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত কাজ শুরু হলে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কারা পালন করবে তা নিয়ে বিরাট দ্বন্ধ দেখা দেয়। যা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে গড়াচ্ছিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযুমী বলেন- যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম হারাম শরীফে প্রবেশ করবে, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সর্ব প্রথম মসজিদে হারামে প্রবেশ করলেন সকলের আস্থা ও প্রিয়ভাজন আল-আমিন মুহাম্মাদ। তাকে দেখে সকলে বলে উঠল- ‘এই যে আল-আমিন। আমরা তার উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ।’

তিনি একটি চাদর চাইলেন। তাতে হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে সকল গোত্রের একেকজনকে বললেন চাদরের পাশ ধরে উচু করার জন্য । যখন সেটি যথাস্থানে নেয়া হল তিনি নিজহাতে তা দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী আল-আমিন মুহাম্মাদের এই সমাধানে সকলেই একটি ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের থেকে রক্ষা পেল।

নবুওয়াতের পূর্বাভাস ও নিঃসঙ্গ প্রিয়তা: নবুওয়াত লাভের সময় যতই নিকটবর্তী হচ্ছিল, ততই তার মধ্যে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গ প্রিয়তা বাড়তে লাগল। তাই তিনি কাবা শরীফ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ছোট গুহার নির্জন স্থানকে বেছে নিলেন। তিনি কয়েকদিনের পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার এসে নিয়ে যেতেন। কখনো কখনো একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতেন। তারপর রবিউল আওয়াল মাস থেকে শুরু হয় সত্যস্বপ্ন দেখা। তিনি তখন স্বপ্নে যা দেখতেন তাই দিবালোকের মত সত্য হত। এভাবে প্রায় ৬ মাস চলল। হেরা গুহায় অবস্থানের কারণ হলো সেখানে একসাথে তিনটি ইবাদত হত। ১. নির্জনবাস ২. আল্লাহর ইবদত ৩. সেখান থেকে কাবা শরীফ দেখতে পাওয়া। এভাবে হেরা গুহায় থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হয়।

চলবে..

লেখকঃ মুহাদ্দিস, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া কাসিমুল উলুম (কওমী মাদরাসা), বলিদাপাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

ইমাম, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মেইন বাসস্ট্যান্ড, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ। Email: faruknomani@gmail.com

About Author Information
আপডেট সময় : ০৭:৩৭:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯
১০০৪ Time View

ছোটদের সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (১ম পর্ব)

আপডেট সময় : ০৭:৩৭:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯

ফারুক নোমানীঃ

(প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের স্পন্দন, প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোট ৬৩ বছর জীবন পেয়েছিলেন। তিনি আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তাঁর জীবনের ৫৩ টি বছর কেটেছে। তার মধ্যে ৪০ বছর নবুওয়াতের আগে ও ১৩ বছর ছিল নবুওয়াতের পরে। এরপর মদীনাতে হিজরত করে জীবনের বাকি ১০টি বছর সেখানে কাটিয়ে ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।)

নবীজী সা. এর মক্কী জীবন
(শৈশব থেকে নবুওয়াত পর্যন্ত)

জন্ম: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম হস্তি বর্ষের (যে বছর ইয়েমেনের শাসক আবরাহা হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান চালিয়েছিল) রবিউল আওয়াল মাসের সোমবারে সুবহে সাদিকের সময় হয়েছে এ মর্মে ইতিহাসবিদগণ একমত। তবে তারিখের বিষয়ে অনেকগুলো মত বর্ণিত আছে। তার মধ্যে ১২ তারিখ প্রশিদ্ধ হলেও আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে ৯ই রবিউল আওয়াল জন্ম তারিখ হয়। খৃস্টীয় হিসেব মোতাবেক ২০ এপ্রিল ৫৭১। (আল্লামা শিবলী নোমানী : সীরাতুন নবী পৃ. ৬১, সুলাইমান মানসুরপুরী : রহমাতুল্লিল আলামিন ১/৪০, )

নাম ও বংশ পরিচয়: তাঁর নাম মুহাম্মাদ। দাদা আবদুল মুত্তালিবই এ নাম রেখেছিলেন। তিনি মক্কার কুরায়েশ বংশের শ্রেষ্ঠ শাখা হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ ও মায়ের নাম আমেনা। দাদার নাম আবদুল মুত্তালিব ও দাদির নাম ফাতেমা। নানার নাম ওয়াহাব আর নানির নাম বাররাহ। দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন বনু হাশেম গোত্রের সরদার আর নানা ওয়াহাব বনু যোহরা গোত্রের সরদার। এ দুইটি গোত্রই কুরায়েশ বংশের সম্ভ্রান্ত ও প্রশিদ্ধ গোত্র ছিল। পিতা আবদুল্লাহ ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন মায়ের গর্ভে ছিলেন।

দুধ পান ও লালন-পালন: জন্মগ্রহণের পর সর্বপ্রথম তিনি তাঁর মা আমেনার দুধ পান করেন। কিছুদিন পর চাচা আবু লাহাবের দাসী সুওয়াইবা তাঁকে দুধ পান করান। এরপর হালিমা সাদিয়া তাঁকে নিয়মিত দুধ পান করান। তৎকালীন আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের রীতি অনুযায়ী শিশু মুহাম্মাদকেও শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উম্মুক্ত পরিবেশে লালন-পালনের জন্য পাঠানো হয়। যা শিশুদেরকে রোগবালই থেকে মুক্ত রাখত ও সুস্থ সবল করে তুলত। বিশেষ করে এতে তারা বিশুদ্ধ আরবিভাষায় অভ্যস্থ হয়ে উঠত। তিনি হালিমা সাদিয়ার বাড়িতে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত থাকেন।

বক্ষ বিদারণ: নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সর্বমোট চারবার বক্ষ বিদারণ করা হয়েছে। প্রথমবার শৈশবে। যখন তিনি হালিমা সাদিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকতেন। সে সময় তার বয়স হয়েছিল চার বছর। ফিরিশতা জিবরাইল আ. এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে গিয়ে বুক চিরে কলিজা বের করে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন। এরপর যমযমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে দিয়ে বলেন-‘এটি তোমার মধ্যকার শয়তানের অংশ’।
দ্বিতীয় বার বক্ষ বিদারণের ঘটনা ঘটেছিল তাঁর ১০ বছর বয়সে। (ইবনু হিশাম) তৃতীয়বার এ ঘটনা নবুওয়াতের প্রাক্কালে সংঘটিত হয়। আর চতুর্থবার ঘটেছিল মিরাজের সময় ।

মা ও দাদার ইন্তেকাল: নবীজীর জন্মের পূর্বেই পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছিলেন। তার বয়স যখন ছয় বছর তখন মা আমেনা স্বামীর কবর যিয়ারতের উদ্দেশে পুত্র মুহাম্মাদ ও দাসী উম্মে আয়মানকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার উত্তরে মদীনার উদ্দেশে রওনা হন। মদীনায় পৌঁছে নাবেগা আল-জা’দীর পারিবারিক কবরস্থানে যিয়ারত শেষে একমাস বিশ্রামের পর আবার মক্কার পথে রওনা হন। কিছু দূর এলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবওয়া নামক স্থানে তাঁর মৃত্যু হয়। যা বর্তমানে মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি শহর। পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতিম বালক মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আবদুল মুত্তালিবের স্নেহ ছায়ায়। কিন্তু এই ছায়াও বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মদের বয়স যখন ৮ বছর তখন তার দাদা আবদুল মুত্তালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। দাদার অসিয়ত অনুযায়ী চাচা আবু তালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর তিনি ভাতিজা মুহাম্মদের যোগ্য অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সিরিয়ার প্রথম সফর: ১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে সর্বপ্রথম ব্যবসার উদ্দেশে তিনি শাম বা সিরিয়ায় সফর করেন। কাফেলা যখন বসরা শহরের নিকটে পৌঁছল, তখন এক খৃস্টান পাদ্রী যার মূল নাম ছিল জারজীস আর প্রসিদ্ধ ছিলেন বাহীরা নামে তার সাথে সাক্ষাৎ হল। বাহীরা ১২ বছরের কিশোর মুহাম্মাদকে দেখে বললেন-‘ইনিই সেই বিশ্বনেতা, ইনিই বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসুল। যাকে আল্লাহ সারা পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন।’ লোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে, সে প্রতিশ্রুত সেই শেষ নবী? তিনি বললেন, যখন তোমরা পাহাড় থেকে নামছিলে তখন পথের পাশের গাছপালা, তরুলতা প্রস্তরখ- তার প্রতি সম্মানার্থে মাথা অবনত করছিল। এসব বস্তু কেবল নবীদেরকেই এভাবে সম্মান জানায়। পাদ্রী বাহীরা বললেন, তোমরা কখনোই তাকে রোমের দিকে নিয়ে যাবে না। রোমবাসী তাকে দেখলে তার গুণাবলী ও লক্ষণসমূহ দেখে চিনে ফেলবে এবং তাকে হত্যা করবে। চাচা আবু তালিবকে ইহুদীদের বিষয়ে সতর্ক করলে তিনি তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান।

ফুজ্জার যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ: ইসলামপূর্ব আরবে যুগ যুগ ধরে যে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছিল তার মধ্যে হরবুল ফুজ্জার বা ফুজ্জার যুদ্ধ অন্যতম। কুরায়েশ ও বনু কায়েস গোত্রের মাঝে সংঘটিত এই যুদ্ধে বুন কায়েস কুরায়েশদের ওপর বিজয় লাভ করে। পরে কুরায়েশরা বুন কায়েসের ওপর বিজয়ী হয়। সবশেষে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

যেহেতু কুরায়েশ বংশের লোকজন ন্যায়সঙ্গত কারণে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং এর সঙ্গে বংশের মানমর্যাদার প্রশ্ন জড়িত ছিল, সেজন্য নবীজী নিজেও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি কাউকে আক্রমণ করেননি। আল্লামা সুহাইলী বলেন-‘তিনি নিজে এ যুদ্ধে (সক্রিয়ভাবে ) যুদ্ধ করেননি যদিও যুদ্ধ করার মত বয়স তখন তার ছিল। এর কারণ, প্রথমত এটি হারাম মাসে সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত উভয় পক্ষই ছিল কাফের। তৃতীয়ত কেবল আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার জন্যই নবীজীকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। যে মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ কারা হারাম ছিল সে মাসে যুদ্ধটি হওয়ায় একে হরবুল ফুজ্জার বা পাপীদের যুদ্ধ বলা হয়।

হিলফুল ফুযুল: আরবের ধারাবাহিক নানা যুদ্ধে যে ভয়বহ পরিণতি হয়েছিল তা কারো কাছেই অস্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে ফুজ্জার যুদ্ধের ভয়াবহতা তো নবীজী সা. নিজচোখে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যা তাকে চরমভাবে ব্যথিত করেছিল। তাই এ সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধানের চিন্তা তাকে তাড়া করে ফিরছিল। তাছাড়া আরো একটি ঘটনা সে সময় ঘটেছিল। যুবায়েদ গোত্রের এক ব্যবসায়ী মাক্কার অন্যতম নেতা আস ইবন ওয়ায়েলের কাছে পণ্য বিক্রি করেন। পণ্য বুঝে নিয়ে আস আর তাকে মূল্য পরিশোধ করে না। ব্যবসায়ী লোকটি সাহায্যের জন্য অন্য সব নেতাদের কাছে যান, কিন্তু তারাও তাকে কোনভাবে সাহায্য করে না। ফলে সে আবু কোবায়েস পাহাড়ে উঠে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করে। যা শুনে নবীজীর চাচা যুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিব তা সমাধানের জন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আবদুল্লাহ বিন জুদআন তাইমির বাড়িতে গোষ্ঠীর প্রধানদেরকে নিয়ে জরুরী বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে নবীজীর দাদা ও নানার গোষ্ঠীসহ পাঁচটি গোষ্ঠী যোগদান করে। উক্ত বৈঠকে নবীজী ৪টি প্রস্তাব করেন আর চাচা যুবায়েরের সমর্থনে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

১. আমরা সমাজ থেকে অশান্তি দূর করব ২. মুসাফিরদের হেফাযত করব ৩. দুর্বল ও গরিবদের সাহায্য করব এবং ৪. অত্যাচারীদেরকে প্রতিহত করব। হরবুল ফুজ্জারের পরে যুলকাদাহর হারাম মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর তারা আস ইবনে ওয়ায়েলের নিকট গিয়ে উক্ত মযলুম ব্যবসায়ীর প্রাপ্য বুঝিয়ে দেন।

সফল ব্যবসায়ী তরুণ মুহাম্মাদ : ব্যবসায়ের উদ্দেশে ১২ বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার উদ্দেশে বের হলেও পাদ্রী বাহীরার কথা শুনে চাচা আবু তালিব তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান। মক্কায় অনেক বিত্তশালী ছিলেন যারা সরাসরি নিজে ব্যবসা না করে নির্দিষ্ট চুক্তিতে বিশ্বস্ত লোকের কাছে পুঁজি বিনিয়োগ করতেন । মক্কার সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিদুষী নারী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদও ছিলেন এমন একজন ব্যবসায়ী। তরুণ মুহাম্মাদের সততা আামানতদারি ও বিশ্বস্ততার কথা শুনে অন্যদের তুলনায় অধিক মুনাফা দেবার প্রতিশ্রুতিতে ব্যবসায়ের প্রস্তাব কররেন। চাচা আবু তালিবের পরামর্শে তিনি তা গ্রহণ করলেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি খাদিজার মাল নিয়ে ব্যবসায়ের জন্য সিরিয়ায় যান। এই ব্যবসায় এত বেশি লাভ হয়েছে যা খাদিজা অন্য কারো কাছ থেকে কখনো পাননি।

খাদিজার সাথে বিবাহ: খাদিজা ছিলেন বিধবা নারী। পরপর তার দুইজন স্বামী মারা যাওয়ায় আরবের নেতৃস্থানীয় অনেকে তার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। নবীজীর সাথে সিরিয়া সফরে খাদিজা তার বিশ্বস্ত দাস মায়সারাকে পাঠান। মায়সারার কাছে নবীজীর মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি এবং উন্নত রুচিবোধের কথা শুনে তার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন । তিনি তার পরিবারের কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। সিরিয়া থেকে ফিরে আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় উভয় পক্ষের মুরব্বীদের সম্মতিক্রমে তাদের বিবাহ হয়। এই বিয়ের মোহরানা ছিল ২০ টি উট। বিবাহের সময় খাদিজার বয়স ছিল ৪০ ও নবীজীর বয়স ছিল ২৫ বছর। তাদের দাম্পত্যজীবন ছিল ২৫ বছর। নবীজীর ৩ পুত্র ও ৪ কন্যার ভেতর ইবরাহীম ব্যতীত ৬ সন্তানের সকলেই ছিল খাদিজার গর্ভজাত। তিনি তার প্রথম স্ত্রী, তাঁর জীবদ্দশায় তিনি অন্য কাউকে বিবাহ করেননি।

কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণে আল-আমিন মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা: কাবা অর্থ চার দেয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কাবার দেওয়াল দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ইবরাহীম ও ইসমাইল আ. এর হাতে নির্মিত আড়াই হাজার বছরের এই পবিত্র গৃহ সংস্কার ও পুনর্নিমাণের প্রয়োজন একান্ত আবশ্যক ছিল। ইবরাহীম আ. এর নির্মাণে কাবা ছিল ৯ হাত উচু চার দেয়াল বিশিষ্ট ঘর। কোন ছাদ ছিল না। কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিল যে, কাবার পুননির্মাণের কাজে সকল গোত্র শরিক থাকবে, তবে তাতে কারো কোন হারামা মাল ব্যয় করা যাবে না। বাকুম নামক জনৈক রোমান কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত কাজ শুরু হলে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কারা পালন করবে তা নিয়ে বিরাট দ্বন্ধ দেখা দেয়। যা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে গড়াচ্ছিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযুমী বলেন- যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম হারাম শরীফে প্রবেশ করবে, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সর্ব প্রথম মসজিদে হারামে প্রবেশ করলেন সকলের আস্থা ও প্রিয়ভাজন আল-আমিন মুহাম্মাদ। তাকে দেখে সকলে বলে উঠল- ‘এই যে আল-আমিন। আমরা তার উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদ।’

তিনি একটি চাদর চাইলেন। তাতে হাজরে আসওয়াদ উঠিয়ে সকল গোত্রের একেকজনকে বললেন চাদরের পাশ ধরে উচু করার জন্য । যখন সেটি যথাস্থানে নেয়া হল তিনি নিজহাতে তা দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শী আল-আমিন মুহাম্মাদের এই সমাধানে সকলেই একটি ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের থেকে রক্ষা পেল।

নবুওয়াতের পূর্বাভাস ও নিঃসঙ্গ প্রিয়তা: নবুওয়াত লাভের সময় যতই নিকটবর্তী হচ্ছিল, ততই তার মধ্যে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গ প্রিয়তা বাড়তে লাগল। তাই তিনি কাবা শরীফ থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে হেরা পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত ছোট গুহার নির্জন স্থানকে বেছে নিলেন। তিনি কয়েকদিনের পানি ও ছাতু নিয়ে যেতেন। ফুরিয়ে গেলে আবার এসে নিয়ে যেতেন। কখনো কখনো একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতেন। তারপর রবিউল আওয়াল মাস থেকে শুরু হয় সত্যস্বপ্ন দেখা। তিনি তখন স্বপ্নে যা দেখতেন তাই দিবালোকের মত সত্য হত। এভাবে প্রায় ৬ মাস চলল। হেরা গুহায় অবস্থানের কারণ হলো সেখানে একসাথে তিনটি ইবাদত হত। ১. নির্জনবাস ২. আল্লাহর ইবদত ৩. সেখান থেকে কাবা শরীফ দেখতে পাওয়া। এভাবে হেরা গুহায় থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হয়।

চলবে..

লেখকঃ মুহাদ্দিস, আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া কাসিমুল উলুম (কওমী মাদরাসা), বলিদাপাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

ইমাম, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মেইন বাসস্ট্যান্ড, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ। Email: faruknomani@gmail.com