ঢাকা:

অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, করোনা মহামারিসহ নানা কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও নতুন কমিটি না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে হতাশা। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন ও আন্দোলনকে সামনে রেখে এসব সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাইকমান্ড।

খোঁজা হচ্ছে রাজপথে আন্দোলনমুখী নেতৃত্ব। নতুন কমিটি হওয়ার গুঞ্জনে ঘুম ভাঙছে অনেক নেতার। পদপ্রত্যাশীরা এখন বেশ সক্রিয়। ভিড় করছেন জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাসা ও অফিসে। এদিকে অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নিজেদের বলয়ের মধ্যে রাখতেও দলের একাধিক নেতা নানা মাধ্যমে হাইকমান্ডকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে অঙ্গসংগঠনের কমিটিকে কেন্দ্র করে দলে বেড়েছে নানা তৎপরতা।

বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, ওলামা দল, জাসাস, কৃষক দল-এ নয়টি অঙ্গসংগঠন। বাকি দুটি ছাত্রদল ও শ্রমিকদল হচ্ছে সহযোগী সংগঠন। এর মধ্যে সম্প্রতি কৃষক দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সব কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। কয়েকদিন আগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের কমিটিও।

দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা জানান, বিগত দিনের আন্দোলন কর্মসূচি ও দলের সাংগঠনিক গতি ফেরাতে বেশির ভাগ অঙ্গ সংগঠন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সারা দেশে কমিটি গঠনে অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। যোগ্য ও ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সুবিধাবাদীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনা হয়েছে। কমিটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ এমনকি গণপদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিএনপির সিরিজ বৈঠকেও বিষয়টি ওঠে আসে। কেন্দ্রীয় ও জেলার অনেক নেতাই অভিযোগ করেন, অঙ্গসংগঠনের কমিটি করার ক্ষেত্রে জেলা নেতাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় করা হচ্ছে না। ঢাকায় বসে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ফলে দলীয় কর্মসূচি কিংবা রাজপথে তাদের পাওয়া যায় না। আগামীদিনের আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে রাজপথে সক্রিয়, যোগ্য ও ত্যাগীদের দিয়ে কমিটি ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তারা। আগামীদিনের আন্দোলন এবং সিরিজ বৈঠকে আসা সুপারিশের ভিত্তিতে অঙ্গসংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির হাইকমান্ড।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আমরা সব জায়গায় নতুন কমিটি করার উদ্যোগ নিই। কিন্তু সরকারের বাধার কারণে অনেক স্থানে কমিটি করতে পারিনি। এর মধ্যে শুরু হয় করোনা মহামারি। এ সময় আমরা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখি। পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় আমরা ফের তা শুরু করেছি। ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরসহ কয়েকটি জেলার নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গসংগঠনগুলোও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে কৃষক দলের কমিটি। পর্যায়ক্রমে মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটিই নতুন করে সাজানো হবে।

তিনি বলেন, কমিটি পুনর্গঠনে যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে এবং হবে। বিগত সময়ে হামলা-মামলা মোকাবিলা করে যারা রাজপথে ছিলেন, তারাই অগ্রাধিকার পাবেন। কারণ, সামনে আমাদের কঠিন সময়। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। তাই আন্দোলনমুখী নেতৃত্বকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবার মতামত নিয়েই এসব কমিটি করবেন।

মহিলা দল : আফরোজা আব্বাসকে সভাপতি ও সুলতানা আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মহিলা দলের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল তা পূর্ণাঙ্গ করা হয়। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পরই শুরু হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ফলে ভেঙে পড়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। মহিলা দলে গতি ফেরাতে দ্রুত নতুন কমিটি করা হচ্ছে।

বর্তমান সভাপতি আফরোজা আব্বাস আর কমিটিতে থাকছেন না। আহ্বায়ক/সভাপতি ও সদস্য সচিব/সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন-শিরীন সুলতানা, সুলতানা রহমান, রেহানা আক্তার রানু, নিলোফার চৌধুরী মনি, হেলেন জেরীন খান, বিলকিস ইসলাম, নায়াবা ইউসুফ, ফরিদা আক্তার প্রমুখ।

নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায় চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক বা সদস্যসচিব হিসাবে আলোচনায় থাকলেও তিনি এ পদে আগ্রহী নন। তাকে ঢাকা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হতে পারে।

যুবদল : সাইফুল আলম নীরবকে সভাপতি ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় এক মাস পর ১১৪ সদস্যের আবার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি সেই নেতৃত্ব।

জানা যায়, যুবদলের কমিটি নিয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে। এক অংশ চাচ্ছে যুবদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সুযোগ দেওয়া হোক। অন্য অংশ চাচ্ছে নতুন কমিটি। তবে এ ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের বড় একটি অংশ নতুন কমিটির পক্ষে। শেষ মুহূর্তে আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ হলেও দ্রুত সময়ে তা বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হতে পারে। আগামী কমিটিতে বর্তমান সভাপতি নীরব আর থাকতে চান না বলে জানা গেছে।

নতুন কমিটিতে আলোচনায় আছেন বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন, মামুন হাসান, মোরতাজুল করিম বাদরু, আবদুল মোনেম মুন্না, তরিকুল ইসলাম বনি, গোলাম মওলা শাহীন, জাকির হোসেন নান্নু, মাহবুবুল হাসান ভুঁইয়া পিংকু। এছাড়া ছাত্রদলের সাবেক নেতা আমিরুল ইসলাম খান আলিম, হাবিবুর রশীদ হাবিব, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, আকরামুল হাসান আলোচনায় আছেন।

স্বেচ্ছাসেবক দল : ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর শফিউল বারী বাবুকে সভাপতি ও আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করে স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। মেয়াদ শেষের এক বছর পর গত বছর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত বছর সংগঠনের সভাপতি শফিউল বারী বাবু মারা যান। নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আলোচনায় আছেন আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, ইয়াসিন আলী, ওবায়দুল হক নাসির, ফকরুল ইসলাম রবিন প্রমুখ।

ছাত্রদল : ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে ফজলুর রহমান খোকন সভাপতি ও ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মাস পর ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে আগের কমিটি হলেও এবার সেটা নাও হতে পারে। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় আছেন ইকবাল হোসেন শ্যামল, রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাইফ মাহমুদ জুয়েল, আমিনুর রহমান আমিন, শাহনেওয়াজ, তানজিল হাসান, রিয়াদ মো. ইকবাল হোসেন, রাকিবুল ইসলাম রাকিব, মো. আমানউল্লাহ আমান, জাকিরুল ইসলাম জাকির, আশরাফুল ফকির লিংকন, মহিউদ্দিন রাজু, করিম প্রধান রনি, মারুফ এলাহী রনি, আক্তার হোসেন, আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াসহ বেশ কয়েকজন।

জাসাস : অধ্যাপক মামুন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক চিত্রনায়ক হেলাল খানের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি জাসাসের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি এ কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নতুন কমিটিতে পদ পেতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আলোচনায় রয়েছেন রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী, এমএ মালেক, হেলাল খান, জাহাঙ্গীর শিকদার জাকির হোসেন রোকন, রফিকুল ইসলাম রফিক, ইথুন বাবু প্রমুখ। এর বাইরে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরকে নেতৃত্বে আনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

মৎস্যজীবী দল : ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১০ বছরের মেয়াদোত্তীর্ণ মৎস্যজীবী দলের কমিটিকে ভেঙে সংগঠনের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম মাহতাবকে আহ্বায়ক ও আবদুর রহিমকে সদস্য সচিব করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ এ কমিটিও নিষ্ক্রিয়। এ সংগঠনটিও ঢেলে সাজানো হবে।

ওলামা দল : ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শাহ মো. নেছারুল হককে আহ্বায়ক এবং মাওলানা নজরুল ইসলাম তালুকদারকে সদস্য সচিব করে ১৭১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। শুধু মিলাদ মাহফিলের মধ্যেই সংগঠনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ বলে অভিযোগ রয়েছে। দ্রুত নতুন কমিটি করে সারা দেশে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে সম্প্রতি সিরিজ বৈঠকে নেতারা পরামর্শ দিয়েছেন।

শ্রমিক দল : ২০১৪ সালের এপ্রিলে শ্রমিক দলের কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও ওই সময় এর প্রতিবাদ জানায় একটি অংশ। দীর্ঘদিন কোন্দলে বিপর্যস্ত থাকার পর কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপে তা কমে আসে। কিন্তু দিবসভিত্তিক কর্মসূচি ছাড়া সংগঠনটিকে রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। শ্রমিক দলের কমিটি পুনর্গঠনেও কাজ চলছে।

এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা দলের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ এবং তাঁতী দলের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও তাদের কোনো তৎপরতা নেই। সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে সৃষ্ট ইস্যুতে মুক্তিযোদ্ধা দলের ভূমিকা নিয়ে ক্ষুব্ধ হাইকমান্ড। এছাড়া বর্তমান সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক আহমেদ খান ছাড়া কাউকে কোনো কার্যক্রমে দেখা যায় না। তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ ছাড়া কাউকে দেখা যায় না।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here