ঢাকা ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: যা হয়, যা হয় না

Reporter Name

সবুজদেশ ডেস্কঃ

বাংলাদেশে এখন কতটুকু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে? সাংবাদিকরা কি সংবাদের গভীরে ঢোকেন? প্রকাশ করেন? ইচ্ছে করলেই কি প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির রিপোর্ট করতে পারেন? এসব নিয়ে ডয়চে ভেলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল মনে করেন, কিছু যে হচ্ছে না, তা নয়৷ তবে সব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান বাধা? নাকি সংবাদ মাধ্যমের মালিকরাই প্রধান অন্তরায়? নাকি সাংবাদিকরাই এখন আর সে চেষ্টা করছেন না? প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান মনে করেন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গেলে সমন্বিত প্রয়াস লাগে৷ এখন সেই প্রয়াসটা নেই৷ কাউকে এককভাবে দায়ি করা ঠিক হবে না৷

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বাঁধা

স্বাধীনতার পর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ হতো৷ আবেদ খানের ওই ধারাবাহিক প্রতিবেদন দিয়েই স্বাধীন দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সূচনা৷ পরবর্তিতে স্বৈরশাসকের চাপে ইত্তেফাক সেই কলাম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল৷

সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘‘এখন সেই চেষ্টাই হচ্ছে না৷ আমরা তো কষ্ট করে সংবাদের গভীরে যেতাম৷ এখন যারা কাজ করছে তাদের সংবাদের গভীরে যাওয়ার আগ্রহ কমে গেছে৷ এর নানাবিধ কারণ রয়েছে৷ আমি যখন ওপেন সিক্রেট কলাম লিখতাম, তখন কিন্তু পত্রিকার মালিকপক্ষ থেকে কোনো বাধা আসেনি৷ এখন শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিলে চলবে না৷ আমরা কী সমন্বিত প্রয়াসটা নিতে পারছি?’’

মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, ‘‘আমরাই অনেকখানি দায়ী, কারণ, সাংবাদিকরা বহুক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় কোনো কিছু পাওয়ার আশায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে দূরে থাকছেন৷ নিজের দলীয় আদর্শের কারণেও বহুক্ষেত্রে তারা এটা করছেন৷ আমার রিপোর্টাররা যখন কোনো অনুসন্ধান করেন, বহু ক্ষেত্রেই আমি অন্য সাংবাদিকদের কাছ থেকে (যারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন) ফোন পাই৷ তারা বলেন, এ রিপোর্ট না দিলে হয় না৷ আমার বা সম্পাদকদের দায়ও কম নয়৷ আমি নিজে প্রতিনিয়ত অনেক প্রকাশযোগ্য রিপোর্ট প্রকাশ করি না, যা রিপোর্টারদের হতাশ করে দেয়৷ নানা কারণে আমরা সাহস হারিয়ে ফেলেছি৷’’

মতিউর রহমান চৌধুরীর মনে করেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি মামলাসহ নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাধিকতার সামনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবল ভীতি তৈরি করেছে৷ প্রতিটি রিপোর্ট লেখার আগে তারা হিসাব করছেন ডিজিটাল আইন নিয়ে৷ মানহানি মামলার অপপ্রয়োগ হচ্ছে৷ একটি ঘটনায় বহু মামলা হচ্ছে, যা সংবিধানের বরখেলাপ৷ কিন্তু কে দেখবে এসব? দুঃখজনক হলেও সত্য সাংবাদিকরা আইনি সুরক্ষা তো দূরের কথা বরং আইনি বাধার মুখেই পড়ছেন৷’’

সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘রাজনৈতিক বিষয়ে হয়ত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কম হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে হচ্ছে৷ সাংবাদিকতার যে নানা ধরনের পুরস্কার দেওয়া হয় তার অনেকগুলোর সঙ্গেই আমি সম্পৃক্ত৷ সেখানে আমি কিন্তু দেখি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নানা বিষয় নিয়েই অনুসন্ধানী রিপোর্ট হচ্ছে৷ এখন কেন সব বিষয়ে হচ্ছে না? তার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, কখনো মালিকদের জন্য, কখনো সম্পাদকীয় নীতির কারণে, আবার কখনো রিপোর্টারই করছেন না, কারণ, তিনি জানেন এটা ছাপা হবে না৷’’

সাংবাদিক গোলাম মোর্তজাও মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের যে মূল সমস্যা, সেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷ যেমন, টাকা পাচার, বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের যে তালিকা বিভিন্নসময় প্রকাশ হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির খবর জানতে হয় বিদেশী গণমাধ্যম দেখে৷ বাংলাদেশের যে মৌলিক সমস্যা সেগুলোর অনুসন্ধান করে প্রকাশ করতে পারছে না বাংলাদেশের গণমাধ্যম৷

না পারার কারণ হিসেবে জনাব মোর্তজা বলেন, ‘‘এর কারণ দু’টি৷ অধিকাংশ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, একটা অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য একজন রিপোর্টারকে যে সময় দিতে হয়, যে পরিমান আর্থিক সাপোর্ট দিতে হয় সেই জায়গাটা বাংলাদেশে একেবারেই অপ্রতুল৷ সেটা টেলিভিশন বা প্রিন্ট মিডিয়া, সব ক্ষেত্রে৷ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কিছুটা পারে৷ আরেকটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসন৷ একই সঙ্গে সেই শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন দেশে কার্যকর৷ যে আইনের কারণে একজন সংবাদকর্মীকে একজন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা যে কোনো সময় গ্রেফতার করতে পারে৷ এটার কারণেই যে হচ্ছে না, বিষয়টি কিন্তু এমন না৷ তবে এই আইনের কারণে সংবাদ মাধ্যম সবসময় ভয়ে থাকে, সংবাদকর্মী সব সময় আতঙ্কে থাকে৷ এর ফলে এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ হয়ে যায়৷’’

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ

১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ থেকে শুরু করে মানবজমিনে ‘ক্যাসেট কেলেংকারি’ এবং সর্বশেষ প্রথম আলোয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেওয়া সোনার মেডেল এবং ক্রেস্টে খাদ মেশানোর বিষয়ের প্রতিবেদন দেশে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে৷ বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷

জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক দীপু সরোয়ার বলেন, ‘‘এখনও যে সুযোগ নেই সেটা বলা যাবে না৷ সাংবাদিকরা চাইলে কিছু কিছু বিষয়ে এখনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারেন৷’’

মানবজমিনে ক্যাসেট কেলেংকারি নিয়ে যে মামলা হয়েছিল সেটি এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন৷ মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন বিচারপতিকে ফোন করেছিলেন৷ সেই রিপোর্ট প্রকাশের পর আমাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু হলো৷ আমরা জবাব দিলাম৷ আদালতে ক্যাসেট হাজির করলাম৷ সিনিয়র আইনজীবীরা আমাদের পক্ষে আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন৷ কিন্তু হাইকোর্ট আমার এবং সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাজার রায় দেন৷ রায়ে এরশাদকেও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন৷ আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করি৷ সে আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি৷ এরশাদ ইতিমধ্যে মারা গেছেন৷’’

সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলও বলছেন, সাংবাদিকরা চাইলে এখনও ভালো কিছু করার সুযোগ আছে৷ তিনি প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসার একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলো একটি পুকুরে বেশ কিছু কুমির আছে, তার মধ্যে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, আপনাকে সাঁতরে পুকুর পাড়ি দিতে হবে৷ ভালো সাঁতারু যেমন এই পুকুর পাড়ি দিতে পারবেন, তেমনি ভালো সাংবাদিক এমন অসংখ্য কুমিরের মধ্যে ভালো প্রতিবেদন করবেন৷ এখন আমাদের সমাজে কখনো মালিক, কখনো রাজনৈতিক দল, কখনো ভূস্বামী, কখনো ছাত্র বা যুব সংগঠন এই কুমিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে৷ ফলে কুমির কখন কী চরিত্র নিয়ে হাজির হবে সেটা বলা মুশকিল৷ এর মধ্যেই আমাদের সাংবাদিকতা করতে হবে৷’’

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানা উদ্যোগ

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেয় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)৷ প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক, প্রবীণ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘‘আমার দৃষ্টিতে ঢাকায় কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলেও মফস্বলে এটা একেবারেই কম৷ ফলে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর মফস্বলের সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাকিতার বিষয়ে প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেই৷ প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে আমরা দেখেছি, অনেক সাংবাদিকই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কী, সেটা বোঝেই না৷ তারা পুলিশ, ইউএনও বা ডিসির বক্তব্য পেলেই মনে করে ভালো রিপোর্ট হয়ে গেছে৷ আমাদের প্রশিক্ষণের পর আমি নিজে লক্ষ্য করেছি, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ভালো কিছু প্রতিবেদন করেছেন৷ পুরোপুরি অনুসন্ধানী না হলেও কাজের মানে তাদের অগ্রগতি হয়েছে৷’’

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পুরস্কার দিয়ে আসছে৷ এছাড়া কর্মশালা ও বিভিন্ন ধরনের ফেলোশিপও দেয় তারা৷ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখরুজ্জামান বলেছেন, ‘‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দুর্নীতি, অপরাধসহ নানা অনিয়ম প্রকাশ ও প্রতিরোধে সহায়তা করে৷ যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে, এই ধরনের প্রতিবেদন থেকে তারা সহায়তা পেয়ে থাকে৷’’

About Author Information
আপডেট সময় : ০৯:২১:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২১
৩২৩ Time View

বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা: যা হয়, যা হয় না

আপডেট সময় : ০৯:২১:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২১

সবুজদেশ ডেস্কঃ

বাংলাদেশে এখন কতটুকু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে? সাংবাদিকরা কি সংবাদের গভীরে ঢোকেন? প্রকাশ করেন? ইচ্ছে করলেই কি প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির রিপোর্ট করতে পারেন? এসব নিয়ে ডয়চে ভেলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল মনে করেন, কিছু যে হচ্ছে না, তা নয়৷ তবে সব ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান বাধা? নাকি সংবাদ মাধ্যমের মালিকরাই প্রধান অন্তরায়? নাকি সাংবাদিকরাই এখন আর সে চেষ্টা করছেন না? প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান মনে করেন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গেলে সমন্বিত প্রয়াস লাগে৷ এখন সেই প্রয়াসটা নেই৷ কাউকে এককভাবে দায়ি করা ঠিক হবে না৷

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বাঁধা

স্বাধীনতার পর দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ হতো৷ আবেদ খানের ওই ধারাবাহিক প্রতিবেদন দিয়েই স্বাধীন দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সূচনা৷ পরবর্তিতে স্বৈরশাসকের চাপে ইত্তেফাক সেই কলাম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল৷

সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘‘এখন সেই চেষ্টাই হচ্ছে না৷ আমরা তো কষ্ট করে সংবাদের গভীরে যেতাম৷ এখন যারা কাজ করছে তাদের সংবাদের গভীরে যাওয়ার আগ্রহ কমে গেছে৷ এর নানাবিধ কারণ রয়েছে৷ আমি যখন ওপেন সিক্রেট কলাম লিখতাম, তখন কিন্তু পত্রিকার মালিকপক্ষ থেকে কোনো বাধা আসেনি৷ এখন শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিলে চলবে না৷ আমরা কী সমন্বিত প্রয়াসটা নিতে পারছি?’’

মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর মতে, ‘‘আমরাই অনেকখানি দায়ী, কারণ, সাংবাদিকরা বহুক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় কোনো কিছু পাওয়ার আশায় অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে দূরে থাকছেন৷ নিজের দলীয় আদর্শের কারণেও বহুক্ষেত্রে তারা এটা করছেন৷ আমার রিপোর্টাররা যখন কোনো অনুসন্ধান করেন, বহু ক্ষেত্রেই আমি অন্য সাংবাদিকদের কাছ থেকে (যারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন) ফোন পাই৷ তারা বলেন, এ রিপোর্ট না দিলে হয় না৷ আমার বা সম্পাদকদের দায়ও কম নয়৷ আমি নিজে প্রতিনিয়ত অনেক প্রকাশযোগ্য রিপোর্ট প্রকাশ করি না, যা রিপোর্টারদের হতাশ করে দেয়৷ নানা কারণে আমরা সাহস হারিয়ে ফেলেছি৷’’

মতিউর রহমান চৌধুরীর মনে করেন, ‘‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানহানি মামলাসহ নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাধিকতার সামনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের মধ্যে প্রবল ভীতি তৈরি করেছে৷ প্রতিটি রিপোর্ট লেখার আগে তারা হিসাব করছেন ডিজিটাল আইন নিয়ে৷ মানহানি মামলার অপপ্রয়োগ হচ্ছে৷ একটি ঘটনায় বহু মামলা হচ্ছে, যা সংবিধানের বরখেলাপ৷ কিন্তু কে দেখবে এসব? দুঃখজনক হলেও সত্য সাংবাদিকরা আইনি সুরক্ষা তো দূরের কথা বরং আইনি বাধার মুখেই পড়ছেন৷’’

সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘রাজনৈতিক বিষয়ে হয়ত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কম হচ্ছে, কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে হচ্ছে৷ সাংবাদিকতার যে নানা ধরনের পুরস্কার দেওয়া হয় তার অনেকগুলোর সঙ্গেই আমি সম্পৃক্ত৷ সেখানে আমি কিন্তু দেখি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নানা বিষয় নিয়েই অনুসন্ধানী রিপোর্ট হচ্ছে৷ এখন কেন সব বিষয়ে হচ্ছে না? তার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়, কখনো মালিকদের জন্য, কখনো সম্পাদকীয় নীতির কারণে, আবার কখনো রিপোর্টারই করছেন না, কারণ, তিনি জানেন এটা ছাপা হবে না৷’’

সাংবাদিক গোলাম মোর্তজাও মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের যে মূল সমস্যা, সেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে না৷ যেমন, টাকা পাচার, বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের যে তালিকা বিভিন্নসময় প্রকাশ হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির খবর জানতে হয় বিদেশী গণমাধ্যম দেখে৷ বাংলাদেশের যে মৌলিক সমস্যা সেগুলোর অনুসন্ধান করে প্রকাশ করতে পারছে না বাংলাদেশের গণমাধ্যম৷

না পারার কারণ হিসেবে জনাব মোর্তজা বলেন, ‘‘এর কারণ দু’টি৷ অধিকাংশ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, একটা অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য একজন রিপোর্টারকে যে সময় দিতে হয়, যে পরিমান আর্থিক সাপোর্ট দিতে হয় সেই জায়গাটা বাংলাদেশে একেবারেই অপ্রতুল৷ সেটা টেলিভিশন বা প্রিন্ট মিডিয়া, সব ক্ষেত্রে৷ কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কিছুটা পারে৷ আরেকটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, কর্তৃত্ববাদী শাসন৷ একই সঙ্গে সেই শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইন দেশে কার্যকর৷ যে আইনের কারণে একজন সংবাদকর্মীকে একজন এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তা যে কোনো সময় গ্রেফতার করতে পারে৷ এটার কারণেই যে হচ্ছে না, বিষয়টি কিন্তু এমন না৷ তবে এই আইনের কারণে সংবাদ মাধ্যম সবসময় ভয়ে থাকে, সংবাদকর্মী সব সময় আতঙ্কে থাকে৷ এর ফলে এক ধরনের সেলফ সেন্সরশিপ হয়ে যায়৷’’

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ

১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে ‘ওপেন সিক্রেট’ থেকে শুরু করে মানবজমিনে ‘ক্যাসেট কেলেংকারি’ এবং সর্বশেষ প্রথম আলোয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেওয়া সোনার মেডেল এবং ক্রেস্টে খাদ মেশানোর বিষয়ের প্রতিবেদন দেশে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে৷ বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে৷

জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা একুশে টেলিভিশনের প্রধান প্রতিবেদক দীপু সরোয়ার বলেন, ‘‘এখনও যে সুযোগ নেই সেটা বলা যাবে না৷ সাংবাদিকরা চাইলে কিছু কিছু বিষয়ে এখনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে পারেন৷’’

মানবজমিনে ক্যাসেট কেলেংকারি নিয়ে যে মামলা হয়েছিল সেটি এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন৷ মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন বিচারপতিকে ফোন করেছিলেন৷ সেই রিপোর্ট প্রকাশের পর আমাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু হলো৷ আমরা জবাব দিলাম৷ আদালতে ক্যাসেট হাজির করলাম৷ সিনিয়র আইনজীবীরা আমাদের পক্ষে আদালতে যুক্তি উপস্থাপন করেন৷ কিন্তু হাইকোর্ট আমার এবং সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাজার রায় দেন৷ রায়ে এরশাদকেও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেন৷ আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করি৷ সে আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি৷ এরশাদ ইতিমধ্যে মারা গেছেন৷’’

সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলও বলছেন, সাংবাদিকরা চাইলে এখনও ভালো কিছু করার সুযোগ আছে৷ তিনি প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসার একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলো একটি পুকুরে বেশ কিছু কুমির আছে, তার মধ্যে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হলো, আপনাকে সাঁতরে পুকুর পাড়ি দিতে হবে৷ ভালো সাঁতারু যেমন এই পুকুর পাড়ি দিতে পারবেন, তেমনি ভালো সাংবাদিক এমন অসংখ্য কুমিরের মধ্যে ভালো প্রতিবেদন করবেন৷ এখন আমাদের সমাজে কখনো মালিক, কখনো রাজনৈতিক দল, কখনো ভূস্বামী, কখনো ছাত্র বা যুব সংগঠন এই কুমিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে৷ ফলে কুমির কখন কী চরিত্র নিয়ে হাজির হবে সেটা বলা মুশকিল৷ এর মধ্যেই আমাদের সাংবাদিকতা করতে হবে৷’’

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানা উদ্যোগ

বাংলাদেশে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেয় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)৷ প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক, প্রবীণ সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘‘আমার দৃষ্টিতে ঢাকায় কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হলেও মফস্বলে এটা একেবারেই কম৷ ফলে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর মফস্বলের সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সাংবাকিতার বিষয়ে প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেই৷ প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে আমরা দেখেছি, অনেক সাংবাদিকই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কী, সেটা বোঝেই না৷ তারা পুলিশ, ইউএনও বা ডিসির বক্তব্য পেলেই মনে করে ভালো রিপোর্ট হয়ে গেছে৷ আমাদের প্রশিক্ষণের পর আমি নিজে লক্ষ্য করেছি, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ভালো কিছু প্রতিবেদন করেছেন৷ পুরোপুরি অনুসন্ধানী না হলেও কাজের মানে তাদের অগ্রগতি হয়েছে৷’’

দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় পুরস্কার দিয়ে আসছে৷ এছাড়া কর্মশালা ও বিভিন্ন ধরনের ফেলোশিপও দেয় তারা৷ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখরুজ্জামান বলেছেন, ‘‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দুর্নীতি, অপরাধসহ নানা অনিয়ম প্রকাশ ও প্রতিরোধে সহায়তা করে৷ যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে, এই ধরনের প্রতিবেদন থেকে তারা সহায়তা পেয়ে থাকে৷’’