কুষ্টিয়া প্রতিনিধি:

মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আলেছা খাতুন তার ভাতার টাকা পাচ্ছিলেন। আলেছা খাতুনও ৮ বছর আগে মারা যান। আলেছা খাতুনের মৃত্যুর ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও তাকে জীবিত দেখিয়ে টাকা তুলে মিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ

ঘটনাটি ঘটেছে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের মিটন গ্রামে। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী আলেছা খাতুন তার ভাতার টাকা উত্তোলন করে আসছিলেন। ৮ বছর আগে তিনি মারা গেলেও তাকে জীবিত দেখিয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুই নেতা এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী জাল স্বাক্ষর করে মিরপুর সোনালী ব্যাংক শাখা থেকে ৮ লাখ দুই হাজার টাকা তুলে নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন প্রয়াত তারই সহযোদ্ধার ভাতার টাকা। এ কাজে সুকৌশলে সহযোগিতা করেছেন মিরপুর সোনালী ব্যাংক শাখায় কর্মরত কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই আত্মসাৎকারী দোষ স্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা নেতা এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী। জড়িত থাকায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অপরাধের শাস্তি হিসেবে দু’জনের ভাতার টাকা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছে মন্ত্রণালয়। এ অপরাধের জন্য মুচলেকা দিয়েই পার পেয়ে যাচ্ছেন তারা। এমন খবর শুনে হতবাক হয়েছেন উপজেলা এলাকার সাধারণ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দুই নেতা এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলীর এমন ঘৃণিত কাজে জড়িত থাকায় ক্ষোভ-প্রকাশ করেছেন উপজেলাবাসী। জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা।

এদিকে মুচলেকা দেওয়া লেখা একটি চিঠি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনাও।

প্রয়াত ওই মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে কাজলী খাতুন বলেন, এত বড় অপরাধীর শাস্তি শুধুই মুচলেকা। শুনেও হাসি পাচ্ছে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ব্যাংক চেক লেখা একটু ভুল হলেই সেই চেক দিয়ে আর টাকা ওঠে না। অথচ মৃত একজন মানুষকে জীবিত দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হলো আট বছর ধরে।

তিনি আরো বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর আমার বোনের ছেলের চাকরির জন্য মুক্তিযোদ্ধার নাতি ছেলে এই মরমে একটি কাগজ তুলতে যায় আমার স্বামী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অফিসে। তা প্রায় ৭ বছর আগের কথা। মায়ের মৃত্যুর কথা জেনেই ওই সময় আমার স্বামীর হাতে থাকা ভাতার বইটি কেড়ে নেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী। তারপর বইটি বার বার চেয়েছি কিন্তু বই আর ফেরত দেননি তারা। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি। এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রভাবশালী দুই নেতা হওয়ায় বইটি ফেরত নিতে পারেনি। অনেককেই বিষয়টি জানিয়েছিলাম কিন্তু কেউ কাজটি করে দেননি।

প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে হাবিল উদ্দিন বলেন, ‘১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর পরই আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মারা যান। তারপর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু হলে মা আলেছা খাতুন তা পাচ্ছিলেন। মা আলেছা খাতুন মারা গেলে তাকে জীবিত দেখিয়ে ৮ বছরে ৮ লাখ দুই হাজার তুলে তা আত্মসাৎ করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এনামুল হক বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী।’

তিনি বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক থেকে অফিসাররা যাচাই-বাছাইয়ে এসে টাকাগুলো নাকি আমিই আত্মসাৎ করেছি বলে উল্টা আমাকেই ভয় দেখান। এ নিয়ে আমার পরিবারে অশান্তি তৈরি হয়। তারপরই ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘটনাটি সামনে নিয়ে আসেন। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর বিচার চাই।’

ভাতার টাকা আত্মসাৎকারী মিরপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এনামুল হক বিশ্বাসের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কলটি রিসিভ করেননি।

মিরপুর সোনালী ব্যাংক শাখার ম্যানেজার মো. শাহিন উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটেছিল আমার আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা থাকাকলীন। আমি আসার পরই বিষয়টি নজরে আসে। তারপরই টাকা উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নজরুল করিম বলেন, ‘১৬৪নং ভাতার বইটি প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী আলেছা খাতুনের। এই বই থেকেই টাকাগুলো তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছিল। বিষয়টি শোনার পরই টাকাগুলো উদ্ধারে কাজ করেছি। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের শনাক্ত করে টাকাগুলো উদ্ধার করে চেকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে।’

মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার লিংকন বিশ্বাস বলেন, ‘দুজনই দোষ স্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আমরা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় দুজনের ভাতার টাকা ৬ মাসের জন্য স্থগিত করেছে। এতে তো আমাদের কিছুই করার নেই। তাদের ভাতার টাকা দেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন মন্ত্রণালয়।’

কুষ্টিয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘এটা সত্যি দুঃখজনক ঘটনা। তবে মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরপর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here