ঢাকা ০৮:২৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রতিপক্ষকে মেরে নেতা হবার দিন শেষ : ঢাবি অধ্যাপিকা

Reporter Name

রাশেদা রওনকঃ

তারাপদ রায়ের সেই কবিতাটির কথা মনে পড়েছে, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে”!

“আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশাস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বকলস পরিয়ে মাংষ খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
………আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

ছাত্ররাজনীতিতে কিছু একটা ঘটনা ঘটলেই আমার ইনবক্স বন্যার মতো ভেসে যায় ছাত্রদের মেসেজে। নুরুলের ওপর হামলা কিভাবে হয়েছে, কী হয়েছিল সেদিন, বিষয়টি লিখছিনা কেনো, কেন চুপ করে আছেন, ইত্যাদি মেসেজে ভরপুর! কিন্তু আর কতবার, কিভাবে আর কতটা লিখলে পরে ছাত্ররাজনীতির ধরন-ধারণে পরিবর্তন আসবে আমার জানা নেই! আদৌ লেখা লেখির কোন মূল্য আছে কিনা তাও জানিনা।

মাঝে মাঝে ভাবি, এসব লেখা লেখি করেই বা কী হবে? কে শুনে কার কথা? তা নাহলে কিভাবে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্য অহংকারের যে উত্তরাধিকারিত্ব, তা এতোটা নিচে নেমে যেতে পারে? তারাপদ রায়ের মতো আজ বলতেই হচ্ছে, “আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।” কিন্তু আসলেই কি আমরা বুঝতে পারছিনা? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করছি কেবল?

যারা এই ঘটনাটির সাথে জড়িত ছিল, তারা সম্ভবত ডাকসু ভবনের মূল্যই অনুধাবন করতে পারেনি! তা না হলে কিভাবে ডাকসু ভবনের উপর থেকে ছাত্র ফেলার মত ঘটনা ঘটাতে পারে? কিভাবে তারা এতোটা ঐতিহ্যময় ভবনের উপর কালিমা লেপন করতে পারলো? ভবন হতে ফেলে দেয়া ছাত্র এখন মৃত্যুর মুখোমুখি! ডাকসু ভবন এর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গর্বের কথা কি তারা আদৌ জানে? যদি জানতো তবে কি এমন ভাবে কলংকিত করতে পারতো?

এভাবে এই ধরণের কিছু ঘটেছিল কি পূর্বে? হ্যাঁ অনেকেই বলবেন, আগে অস্ত্র মহড়া হতো ক্যাম্পাসে! কিন্তু সে অনেক কাল আগের কথা, আগের সেই যুগ কি এখন আছে? না আছে সেই পরিস্থিতি! বিশ্বায়নের এই যুগে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কি এখন বেমানান নয়? কী হবে এসব করে? দলে অভিনন্দন পাবে, পদ পদবী’র আশায়?

দুঃখিত সময় পাল্টেছে, আর দল এতো শক্তিশালী ও ক্ষমতার জায়গায় যে, এই ধরনের সন্ত্রাসীদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে সময় নেবে না, অভিনন্দিত করা তো দূরের কথা! তাহলে ব্যক্তি মানুষগুলোর কী লাভ হলো এসব সন্ত্রাসী কাজ করে? কেবল ঘৃণা অর্জন ছাড়া? আওয়ামী লীগের রাজনীতি না বুঝে করা নিজের বিপদ ডেকে আনার সামিল!

এই দল যখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশ্বের দরবারের অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের ইমেজকে তুলে ধরতে সর্বদা কাজ করে চলছে, তখন এর অঙ্গসংগঠন এর বাহক হিসেবে কে কি করে বেড়াচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই আমলে আনা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সময়ে যখন পুরো জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘মুজিববর্ষ’ পালনের ঠিক এই সময়টিতেই কেন ছাত্ররাজনীতিতে এই সংকট তৈরি করা হচ্ছে- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। নয়তো আমরা বুঝতেই পারবোনা, “আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

আরেকটি কথা, নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। পারলে এবং সাহস থাকলে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা নিয়ে ভিপি হবার প্রতিযোগিতা করার আশা করা যেতে পারে, সেইজন্য কাজ করা যেতে পারে কিন্তু নির্বাচিত একজন ভিপিকে মেরে ঘৃণা অর্জন করে কী লাভ? এই বোধ না থাকলে রাজনীতির বোধ আসবে কি করে মনে? শিক্ষার্থীদের মন জয় না করে, প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মেরে আর যাই হউক, নেতা হবার দিন শেষ হয়ে গেছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাকে নির্বাচিত করেছে, এমন একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর আক্রমণ করার পরবর্তী ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়েও ভাবছে না কেউ!! আমরা কেউ ভাবছি না। কী হবে এই ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ! হায় ছাত্র রাজনীতি, আমরা কবে বুঝবো যে, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে….।

লেখকঃ অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

About Author Information
আপডেট সময় : ০১:১৪:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯
৫৯২ Time View

প্রতিপক্ষকে মেরে নেতা হবার দিন শেষ : ঢাবি অধ্যাপিকা

আপডেট সময় : ০১:১৪:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯

রাশেদা রওনকঃ

তারাপদ রায়ের সেই কবিতাটির কথা মনে পড়েছে, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে”!

“আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশাস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, ‘ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ’।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বকলস পরিয়ে মাংষ খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
………আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

ছাত্ররাজনীতিতে কিছু একটা ঘটনা ঘটলেই আমার ইনবক্স বন্যার মতো ভেসে যায় ছাত্রদের মেসেজে। নুরুলের ওপর হামলা কিভাবে হয়েছে, কী হয়েছিল সেদিন, বিষয়টি লিখছিনা কেনো, কেন চুপ করে আছেন, ইত্যাদি মেসেজে ভরপুর! কিন্তু আর কতবার, কিভাবে আর কতটা লিখলে পরে ছাত্ররাজনীতির ধরন-ধারণে পরিবর্তন আসবে আমার জানা নেই! আদৌ লেখা লেখির কোন মূল্য আছে কিনা তাও জানিনা।

মাঝে মাঝে ভাবি, এসব লেখা লেখি করেই বা কী হবে? কে শুনে কার কথা? তা নাহলে কিভাবে আমাদের ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্য অহংকারের যে উত্তরাধিকারিত্ব, তা এতোটা নিচে নেমে যেতে পারে? তারাপদ রায়ের মতো আজ বলতেই হচ্ছে, “আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।” কিন্তু আসলেই কি আমরা বুঝতে পারছিনা? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করছি কেবল?

যারা এই ঘটনাটির সাথে জড়িত ছিল, তারা সম্ভবত ডাকসু ভবনের মূল্যই অনুধাবন করতে পারেনি! তা না হলে কিভাবে ডাকসু ভবনের উপর থেকে ছাত্র ফেলার মত ঘটনা ঘটাতে পারে? কিভাবে তারা এতোটা ঐতিহ্যময় ভবনের উপর কালিমা লেপন করতে পারলো? ভবন হতে ফেলে দেয়া ছাত্র এখন মৃত্যুর মুখোমুখি! ডাকসু ভবন এর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গর্বের কথা কি তারা আদৌ জানে? যদি জানতো তবে কি এমন ভাবে কলংকিত করতে পারতো?

এভাবে এই ধরণের কিছু ঘটেছিল কি পূর্বে? হ্যাঁ অনেকেই বলবেন, আগে অস্ত্র মহড়া হতো ক্যাম্পাসে! কিন্তু সে অনেক কাল আগের কথা, আগের সেই যুগ কি এখন আছে? না আছে সেই পরিস্থিতি! বিশ্বায়নের এই যুগে এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কি এখন বেমানান নয়? কী হবে এসব করে? দলে অভিনন্দন পাবে, পদ পদবী’র আশায়?

দুঃখিত সময় পাল্টেছে, আর দল এতো শক্তিশালী ও ক্ষমতার জায়গায় যে, এই ধরনের সন্ত্রাসীদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে সময় নেবে না, অভিনন্দিত করা তো দূরের কথা! তাহলে ব্যক্তি মানুষগুলোর কী লাভ হলো এসব সন্ত্রাসী কাজ করে? কেবল ঘৃণা অর্জন ছাড়া? আওয়ামী লীগের রাজনীতি না বুঝে করা নিজের বিপদ ডেকে আনার সামিল!

এই দল যখন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশ্বের দরবারের অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বাংলাদেশকে ও বাংলাদেশের ইমেজকে তুলে ধরতে সর্বদা কাজ করে চলছে, তখন এর অঙ্গসংগঠন এর বাহক হিসেবে কে কি করে বেড়াচ্ছে সেটা নিশ্চয়ই আমলে আনা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সময়ে যখন পুরো জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘মুজিববর্ষ’ পালনের ঠিক এই সময়টিতেই কেন ছাত্ররাজনীতিতে এই সংকট তৈরি করা হচ্ছে- এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। নয়তো আমরা বুঝতেই পারবোনা, “আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

আরেকটি কথা, নুরুল হক ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। পারলে এবং সাহস থাকলে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা নিয়ে ভিপি হবার প্রতিযোগিতা করার আশা করা যেতে পারে, সেইজন্য কাজ করা যেতে পারে কিন্তু নির্বাচিত একজন ভিপিকে মেরে ঘৃণা অর্জন করে কী লাভ? এই বোধ না থাকলে রাজনীতির বোধ আসবে কি করে মনে? শিক্ষার্থীদের মন জয় না করে, প্রতিপক্ষকে পিটিয়ে মেরে আর যাই হউক, নেতা হবার দিন শেষ হয়ে গেছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাকে নির্বাচিত করেছে, এমন একজন নির্বাচিত ভিপির ওপর আক্রমণ করার পরবর্তী ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়েও ভাবছে না কেউ!! আমরা কেউ ভাবছি না। কী হবে এই ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ! হায় ছাত্র রাজনীতি, আমরা কবে বুঝবো যে, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে….।

লেখকঃ অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।