ফারুক নোমানীঃ

মানুষের রোগব্যাধি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। আবার একটি নিয়ামতও বটে। আল্লাহ তা‘য়ালা যাকে চান, যেভাবে চান, যখন চান রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং তার ঈমানের শক্তি ও স্বচ্ছতা যাচাই করেন। কুরআনুল কারীমে তিনি বলেছেন-‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা আম্বিয়া: ৩৫)।

সুতরাং রোগে আক্রান্ত হয়ে সাওয়াবের নিয়তে যে ধৈর্যধারণ করবে, সে আল্লাহর কছে প্রতিদান পাবে। আল্লাহ তা‘য়ালা তার পাপরাশী মাফ করে দিবেন, মার্জনা করবেন তার অপরাধসমূহ। বৃদ্ধি করবেন তার সম্মান ও মর্যাদা। তাঁর করুণা ও অনুগ্রহ থাকবে তার সাথেই।

প্রখ্যাত সাহবী আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘মুসলিমের প্রতি যখন কোন বিপদ, কোন রোগ, কোন ভাবনা, কোন চিন্তা, কোন কষ্ট বা কোন দুঃখ পৌঁছে, এমনকি তার শরীরে কোন কাঁটা ফুটলেও তা দ্বারা আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪২, সহীহ মুসলিম ২৫৭২)।

আবু হুরায়রা রা. হতে অপর আরেকটি হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘আল্লাহ যার ভালো চান তাকে বিপদগ্রস্ত করেন।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪৫, মালেক ২৭১৩, আহমাদ ৭২৩৫)।

রোগব্যাধি খারাপ নয়

অনেকেই অন্যের রোগব্যাধি বা বিপদাপদে বিরূপ মন্তব্য করে বলে- ‘সে যদি ভালোই হবে তাবে তার এ রোগবালাই হলো কেন?’ এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা ও অবান্তর ধারণা। রোগব্যাধি একটি পরীক্ষা। আর পরীক্ষা হয় যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য। সুতরাং কার কেমন ঈমানী শক্তি আছে তা যাচাইয়ের জন্যই আল্লাহ রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। তাই এমন ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করার কোন সুযোগ ইসলামে নেই। এটা বুঝানোর জন্য আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর রাসূল সা.কে বিভিন্ন সময় রোগব্যাধি দিয়েছেন। রোগ যেমন মানুষের গোনাহ মাফের একটি মাধ্যম, আবার উচ্চমর্যাদা প্রাপ্তিরও উপকরণ। নবীজী সা. এর কোন গোনাহ ছিল না। তাই রোগ বালাই দিয়ে আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর মর্যাদাকে আরো উন্নীত করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা.বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট উপস্থিত হলাম। তখন তিনি ভীষণ জ্বরে ভুগছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ! তোমাদের দু’জনের সমপরিমাণ জ্বর আমার হয়ে থাকে। আমি বললাম, আপনার তো দ্বিগুণ সাওয়াব। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, হ্যাঁ। তারপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন-‘কোন মুসলিমের প্রতি যেকোন কষ্ট আসুক না কেন, চাই সেটা অসুস্থতা বা অন্য কিছুই হোক। আল্লাহ তা‘য়ালা এর দ্বারা তার গুনাহসমূহ ঝেড়ে দেন, যেমনিভাবে গাছ তার পাতা ঝেড়ে ফেলে।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪৭, সহীহ মুসলিম ২৫৭১, দারামী ২৮১৩, আহমাদ ৪২০৫)।

নবীজী সা. নিজেই যখন রোগের কষ্ট সহ্য করেছেন। রোগের মাধ্যমে পরীক্ষা যখন তাঁর উপরও এসেছে। তখন খুব সহজেই বলা চলে, রোগব্যাধি মূলত ঈমানদারের ঈমানের প্রকাশক। তাই তো আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন-‘মুমিনের উপমা হলো তৃণ লতার মত। যাকে বাতাস এদিকে সেদিকে দোলায়, আর মুমিনের উপর সর্বদা মুসিবত এসে থাকে। আর মুনাফিকের উপমা হলো, সে যেন ভূমির উপর কঠিনভাবে স্থাপিত বৃক্ষ, যাকে কোন ক্রমেই নোয়ানো যায় না। অবশেষে এক ঝটকায় মূলসহ তা উৎপাটিত হয়ে যায়।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৪৩, ৫৬৪৪,সহীহ মুসলিম ২৮০৯, ২৮১০)।

ক্লাসের সব ছাত্র যেমন এক রকম হয় না, তেমনি দুনিয়ার সকল মুমিনও একরকম ঈমানের অধিকারী নন। ক্লাসে ভালো ছাত্রকে প্রশ্ন করলে শিক্ষক যেমন একটু কঠিন প্রশ্নই করেন, তেমনই আল্লাহ তা‘য়ালা দুনিয়ার এই পরীক্ষার হলে তুলনামূলক বড় পরীক্ষাটিই করেন শক্তিশালী ঈমানদারকে। এ প্রসঙ্গে মুসআব ইবনু সা‘দ রা. হতে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত হাদীসটি লক্ষণীয়। তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! বিপদ দ্বারা সর্বাপেক্ষা পরীক্ষা করা হয় কাদের? তিনি বললেন-‘নবীদেরকে। তারপর তাঁদের তুলনায় যারা অপেক্ষাকৃত কম উত্তম তাদেরকে। মানুষ তার দীনদারীর অনুপাতে বিপদগ্রস্ত হয়। যদি সে তার দীনের ব্যাপারে শক্ত হয়, তবে তার বিপদও শক্ত হয়ে থাকে। আর যদি তার দীনের ব্যাপারে তার শিথিলতা থাকে, তার বিপদও শিথিল হয়ে থাকে। তার এমন বিপদ হতে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীতে চলাফেরা করে অথচ তার কোন গুনাহ থাকে না।’ (তিরমিযী ২৩৯৮, ইবনু মাজাহ ৪০২৩, ৪০২৪, দারামী ২৮২৫, আহমাদ ১৪৮১, ১৪৯৪, ১৫৫৫, ১৬০৭)।

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন মহিলার প্রতি বিপদ লেগেই থাকে। (যেমন) তার নিজ শরীরে, তার ধন-সম্পদে কিংবা তার সন্তানদের ব্যাপারে। যতক্ষণ না সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে। আর তখন তো তার উপর কোন গুনাহের বোঝাই থাকে না।’ (আহমাদ ৭৮৫৯, ৯৮১১, হাকিম ১২৮১)।

আমরা অনেক সময় ধৈর্যহারা হয়ে পড়ি, দুমড়ে-মুচড়ে যাই। বলি, আল্লাহ আর কাউকে পেলেন না আমাকে ছাড়া! যত বিপদ সব আমার উপরই আসে। এমন কথা বলার অর্থ হল, আল্লাহ তা‘য়ালার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করা। অথচ আল্লাহ তা‘য়ালা এ বিপদ কল্যাণের জন্যই দিয়েছেন। দুনিয়াতে যারা বিপদে আক্রান্ত ছিল, হাশরের ময়দানে তারা দেখবে এর বিনিময়ে তাদেরকে প্রচুর পরিমাণে সাওয়াব দেয়া হয়েছে। তখন বিপদমুক্ত যারা ছিল তারা আক্ষেপ করতে থাকবে। এ সম্পর্কে জাবির রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন-‘(দুনিয়াতে) সুখ-শান্তি ভোগকারী ব্যক্তিরা যখন কিয়ামতের দিন দেখবে যে, বিপদগ্রস্থ লোকদের সাওয়াব দেয়া হচ্ছে। তখন তারা আক্ষেপ করবে; আহ! দুনিয়াতে যদি তাদের চামড়া কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলা হতো।’ (তিরমিযী ২৪০২, আল আহাদীসুস সাহীহাহ ২২০৮)।

উপরিউক্ত হাদীসসমূহ দ্বারা এটাই স্পষ্ট যে, বিপদ আপদ, রোগ-বালাই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের পরীক্ষার জন্য। তার উপর ধৈর্যধারণে আছে অসীম সাওয়াবের ঘোষণা। তবে ইচ্ছাকৃত কখনোই কোনভাবে বালা-মুসিবত ও রোগব্যাধির কামনা করা যাবে না। অবশ্য রোগ হলে সবর করতে হবে। ধৈর্যহারা হয়ে পড়বে না বা মৃত্যুর কামনা করবে না। বিপদে পড়ে মৃত্যু কামনা করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে।

সাহাবী আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ দুঃখ-দৈন্যে নিপতিত হওয়ার কারণে যেন মৃত্যু কামনা না করে। যদি এমন কিছু করতেই হয়, তা হলে সে যেন বলে, হে আল্লাহ! আমাকে জীবিত রাখ, যতদিন পর্যন্ত আমার জীবিত থাকা কল্যাণকর হয় এবং আমাকে মৃত্যু দাও, যখন আমার জন্য মৃত্যু কল্যাণকর হয়।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৭১, ৬৩৫১, সহীহ মুসলিম ২৬৮০)।

রোগী দেখার ফযিলত

একজন অসুস্থ ব্যক্তি যখন শয্যাশায়ী থাকেন, তখন তার শারীরিক কষ্টের তুলনায় মানসিক কষ্টই বেশি হয়। অসুস্থতার পাশাপাশি একাকীত্বের বেদনা তাকে আরো বেশি অতিষ্ঠ করে তোলে। এ জন্য ইসলাম বারবার উৎসাহ দিয়েছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, মহাপুণ্যের ঘোষণা করেছে রোগীকে দেখতে যাওয়ার জন্য। স্বয়ং নবীজী সা. নিজেই স্বশরীরে উপস্থিত হতেন অসুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে। বসতেন তার পাশে। শোনাতেন সান্ত¦নার বাণী। বলতেন- ‘সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা করা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. অনেক প্রেরণা দিয়েছেন, হাদীসে অনেক ফযিলতের কথা বলেছেন: আলী রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজী সা. কে বলতে শুনেছি-‘যে মুসলিম অপর কোন অসুস্থ মুসলিমকে সকাল বেলায় দেখতে যায়, তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনার দুআ করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যা বেলায় দেখতে যায়, তাহলে তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা সকাল পর্যন্ত দুআ করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরি করা হয়।’ (তিরমিযী ৯৬৯, আবু দাউদ ৩০৯৮, আহমাদ ৯৭৫)।

সাওবান রা. হতে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন- ‘রোগীর সেবা-শুশ্রুষাকারী বেহেশতের বাগানে অবস্থান করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে না ফিরে আসে।’ (সহীহ মুসলিম ২৫৬৮, তিরমিযী ৯৬৭)।

জাবের রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি কোন রোগীকে দেখতে যায় সে আল্লাহর রহমতের সাগরে সাঁতার কাটতে থাকে যতক্ষণ না সেখানে গিয়ে বসে। যখন সে সেখানে গিয়ে বসে তখন (সে আল্লাহর রহমতের সাগরে) ডুব দিল।’ (আহমাদ ১৪২৬০, ১১৬৬, ইবনু আবী শায়বা ১০৯৩৯, ইবনু হিব্বান ২৯৫৬, হাকিম ১২৯৫)।

আবু হুরায়রা রা. থেকেও বর্ণিত হাদীস আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘ কোন ব্যক্তি রোগীকে দেখতে গেলে আকাশ থেকে একজন আহবানকারী তাকে ডেকে বলেন, তুমি উত্তম কাজ করেছো, তোমার পথ চলা কল্যাণময় হোক এবং তুমি জান্নাতে একটি বাসস্থান নির্ধারণ করে নিলে।’ (তিরমিযী ২০০৮, ইবনু মাজাহ ১৪৪৩)।

এখানে লক্ষণীয় একটি বিষয় যে, নবীজী সা. অধিকাংশ হাদীসে ‘কোন অসুস্থ ব্যক্তি’ বা ‘কোন রোগী’ বলে এদিকেই ঈঙ্গিত করেছেন যে, রোগী মুসলিম হোক বা অমুসলিম, পরিচিত বা অপরিচিত, কাছের বা দূরের, ছোট হোক বা বড়, নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন তাকে দেখতে গেলে, সেবা-শুশ্রুষা করলে এই সাওয়াব বা পুরস্কার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা রয়েছে। এখানে জাতি, ধর্ম ও বর্ণের প্রতি শর্তারোপ না করে যেটাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো ‘মানুষ’। অতএব একটি অসুস্থ মানুষ সে যেই হোক না কেন ইসলাম তাকে দেখাশোনা ও সেবা শুশ্রুষার উৎসাহ ও আদেশ দিয়েছে।

এটি একটি গুরুদায়িত্বও

রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা করা এটি শুধু একটি সাওয়াব বা পুণ্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি মানবিক ও সামাজিক গুরুদায়িত্বও। যে ব্যাপারে নবীজী সা. বারবার তাগিদ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি অধিকার আছে: সালামের জবাব দেয়া, দাওয়াত কবুল করা, জানাযায় উপস্থিত হওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া এবং হাঁচিদাতা আলহামদু লিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা।’
(সহীহ বুখারী ১২৪০, সহীহ মুসলিম ২১৬২, আহমাদ ১০৯৬৬)।

বারা ইবনু আযিব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সাতটি জিনিসের আদেশ দিয়েছেন এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তারপর তিনি উল্লেখ করলেন: পীড়িত ব্যক্তির খোঁজখবর নেয়া, জানাযার অনুসরণ করা, হাঁচির জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা, সালামের জওয়াব দেয়া, মাজলুমকে সাহায্য করা, আহবানকারীর প্রতি সাড়া দেয়া, কসমকারীকে দায়িত্ব মুক্ত করা। (সহীহ বুখারী ১২৩৯, ২৪৪৫, ৫১৭৫, সহীহ মুসলিম ২০৬৬)।

যারা রোগীর দেখাশোনা বা সেবা শুশ্রুষা করা থেকে বিরত থাকে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার এক ভয়াবহ মুহূর্ত। আল্লাহ তা‘য়ালা তখন মুসলিম বা মুমিন বলে সম্বোধন করবেন না। বরং আদম সন্তান বলে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন, কেন তাঁকে সে সেবা করেনি। মানুষের সেবা করাকে সেদিন তিনি তাঁর নিজের সেবা করার সাথে তুলনা করবেন। এভাবে বলবেন, ‘আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমার সেবা করনি।’

আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ তা‘য়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ হয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমার শুশ্রুষা করনি।’ বান্দা বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমি কী করে আপনার শুশ্রুষা করব? আপনি তো বিশ্বপালনকর্তা। আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তুমি তার সেবা করনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি তার সেবা শুশ্রুষা করলে তার কাছেই আমাকে পেতে।’ (সহীহ মুসলিম ২৫৬৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৭৩৬)।

নবীজী যখন রোগীর বাড়ি

নবীজী সা. শুধু রোগী দেখার ফযিলত বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং কারো অসুস্থতার সংবাদ পেলে নিজেই উপস্থিত হতেন তার বাড়িতে। তার সুস্থতার জন্য দুআ করতেন। তার চাহিদার প্রতি লক্ষ রাখতেন। শুনতেন তার মনের চাহিদাটি। উত্তরে যা বলা হত, তিনি তার ব্যবস্থা করতে আদেশ দিতেন। তিনি সকলকেই দেখতে যেতেন। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিটি অমুসলিম হলেও তিনি খোঁজ-খবর নিতেন, তার বাড়িতে যেতেন তাকে দেখতে। তিনি ফজর ও আসরের নামাযের পর উপস্থিত মুসল্লিদের দিকে ফিরে বসতেন। কারো চেহারায় দুঃচিন্তা বা পেরেশানির ছাপ দেখলে কারণ জিজ্ঞাসা করতেন। নামাযে কাউকে না পেলে শুনতেন সে অসুস্থ কি না!

কত উদারতা শিখিয়েছে ইসলাম এই পৃথিবীকে। কত উদার ছিলেন প্রিয়তম নবী নিজেই। কতইনা মমতা ছিল তাঁর অসুস্থ ব্যক্তির প্রতি। হোক সে খ্যাতনামা বা অখ্যাত। দেখতে যেতেন তিনি তাকে। মায়া ও মমতার কি এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি!

এ ব্যাপারে জাবের রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকর রা. পদব্রজে আমাকে দেখতে আসেন। আমি তখন বনু সালিমায় অবস্থান করছিলাম। (সহীহ বুখারী ১৯৪, ৪৫৭৭, ৫৬৫১, সহীহ মুসলিম ১৬১৬)।

সা‘দ ইবনু মালিক রা. বলেন, আমি অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে দেখতে এলেন। (সহীহ বুখারী ৫৩৫৪, তিরমিযী ৯৭৫, আহমাদ ১৫৬৭)।

উবাদাহ ইবনুস সামিত রা. বলেন, আমি অসুস্থ ছিলাম। আনসারী কিছু লোক আমাকে দেখতে এলেন। আমি তাদের ভেতর ছিলাম, এমন সময় রাসূলুল্লাহ সা. আমার খোঁজ-খবর নিতে এলেন। (আহমাদ ২২৭০২)।

আমির ইবনু সা‘দ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বিদায় হজের সময় আমার রোগ কঠিন আকার ধারণ করলে রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের দেখতে আসলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৩৯৩৬, ৪৪০৯, ৫৬৬৮, ৬৩৭৩, সহীহ মুসলিম ১৬২৮)।

প্রিয়নবীর এই সেবা, এই ভালোবাসা শুধু শহরের লোকদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর সেবা ছিল সকলের জন্যই উম্মুক্ত। তাই তো তিনি বস্তির অসুস্থ বেদুঈনদেরকেও দেখতে যেতেন। তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। এ সম্পর্কেই সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. জনৈক বেদুঈনের কাছে গিয়েছিলেন, তার রোগের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এর নিয়ম ছিল তিনি যখন কোন রোগীকে দেখতে যেতেন তখন তাকে বলতেন, ‘কোন ক্ষতি নেই ইনশাআল্লাহ তুমি তোমার গোনাহ থেকে পবিত্রতা লাভ করবে।’ (সহীহ বুখারী ৩৬১৬, ৫৬৫৬, ৭৪৭০, আহমাদ ১৩৬১৬)।

অন্যদিকে তিনি শুধু মুসলিমদেরকেই সেবা শুশ্রুষা করতেন এমন নয় বরং মুসলিম, অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষকেই তিনি সেবা করেছেন এবং সেবা করার কথাও তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। অবাক করা বিষয় হলো, এখানে তিনি মুসলিম অমুসলিমের মাঝে কোন পার্থক্য করেননি, সুতরাং যে কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে সেবা করলেই সে এই ফযিলত ও মর্যাদা পাবে।

আনাস রা. বলেন, এক ইয়াহুদীর ছেলে রাসূলুল্লাহ সা. এর খেদমত করত। ছেলেটির অসুখ হলে রাসূলুল্লাহ সা. তাকে দেখতে গেলেন। (সহীহ বুখারী ১৩৫৬, ৫৬৫৭)।

শুধু বড় বা প্রাপ্ত বয়স্করাই সেবা- শুশ্রুষা পাবে এমন নয়, নিষ্পাপ শিশুরাও এ সেবা প্রাপ্তির অধিকারী। তাদের দেখাশোনা ও সেবা করলেও একই সাওয়াব অর্জন হবে। নবীজী সা. নিজেই এমন অবুঝ অসুস্থ শিশুদের দেখতে যেতেন।

উসামা ইবনু যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এর এক কন্যা (যায়নাব) তাঁর কাছে সংবাদ পাঠিয়েছেন, এসময় উসামা, সা‘দ ও সম্ভবত উবায় রা. রাসূলুল্লাহ সা. এর সঙ্গে ছিলেন। সংবাদ ছিল এ মর্মে যে, (যায়নাব বলেছেন) আমার এক শিশুকন্যা মৃত্যুশয্যায় শায়িত। কজেই আপনি আমাদের এখানে আসুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. তার কাছে সালাম পাঠিয়ে বলে দিলেন: সব আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি যা চান নিয়ে নেন, আবার যা চান দিয়ে যান। তার কাছে সব কিছু একটি নির্ধারিত সমতা আছে। কাজেই তুমি ধৈর্যধারণ কর এবং উত্তম প্রতিদানের আশায় থাকো। তারপর আবারো তিনি রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে কসম ও তাগিদ দিয়ে সংবাদ পাঠালে রাসূলুল্লাহ সা. উঠে দাঁড়ালেন। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম। এরপর শিশুটিকে রাসূলুল্লাহ সা. এর কোলে তুলে দেয়া হল। এ সময় তার নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছিল। রাসূলুল্লাহ সা. এর দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। সা‘দ রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি? তিনি উত্তর দিলেন: এটা রহমত। আল্লাহ তার মেহেরবান বান্দাদের প্রতিই মেহেরবানী করে থাকেন। (সহীহ বুখারী ১২৮৪, আবু দাউদ ৩১২৫)।

আয়শা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. মদীনায় আসলেন, তখন আবু বকর ও বিলাল রা. জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমি তাদের কাছে গেলাম এবং বললাম হে আব্বাজান! আপনি কেমন অনুভব করছেন? হে বিলাল! আপনি কেমন অনুভব করছেন। (সহীহ বুখারী ১৮৮৯, ৩৯২৬)।

সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার খালা আমাকে রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে নিয়ে গেলেন। এরপর তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বোনের ছেলেটি অসুস্থ। তখন নবী সা. আমার মাথায় হাত বুলালেন এবং আমার জন্য বরকতের দুআ করলেন। (সহীহ বুখারী ১৯০, ৫৬৭০, ৬৩৫২, সহীহ মুসলিম ১২৪৫, তিরমিযী ৩৬৪৩)।

উম্মু আলা রা. বলেন, একদা আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সা. আমার দেখতে এসে বলেন: হে উম্মু আলা! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা, মুসলমানদের অসুখের দ্বারা আল্লাহ তাদের গোনাহ তেমনি দূর করে দেন, যেমনি অগ্নি সোনা-রূপার মরিচা দূর করে দেয়। (আবু দাউদ ৩০৯২)।

এ হাদীস দ্বারা বুঝা গেল যে, অসুস্থ ব্যক্তি নারী হলেও তার খোঁজ খবর নেয়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

রোগীকে সান্তনা দেয়া

আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-‘তোমরা রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গেলে তার দীর্ঘায়ু কামনা করবে। যদিও তা কিছুই প্রতিরোধ করতে পারে না, তবুও রোগীর অন্তরে আনন্দের উদ্রেক করে।’ ( তিরমিযী ২০৮৭, ইবনু মাজাহ ১৪৩৮)।

অসুস্থ ব্যক্তিকে সান্তনা দিতে, আশার কথা শোনাতে ইসলাম যেমন আদেশ দিয়েছে, তেমনি বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানও একই কথা বলেছে। শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও মনে যদি বল থাকে একজন ব্যক্তি চলতে পারে। কিন্তু তার মনবল ভেঙ্গে দিলে বা হতাশার কথা শোনালে সে আরো দুর্বল, আরো নিরাশ হয়ে পড়ে। তাই কোন রোগীকে দেখতে গিয়ে তার কাছে সান্তনার কথা না বলে যদি তার মন ভেঙ্গে দেয়, তাহলে সে তার উপকারের পরিবর্তে তার ক্ষতিই করা হল।

রোগীর চাহিদার কথা শোনা ও তা বাস্তবায়ন করা

ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা. এক রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে বললেন: তুমি কী চাও? সে বলল, আমি গমের রুটি খেতে চাই। নবীজী সা. বললেন: কারো কাছে গমের রুটি থাকলে সে যেন তা তার ভাইয়ের জন্য পাঠায়। অতপর নবীজী সা. বলেন, তোমাদের কারো রোগী কিছু খেতে আকাঙ্খা করলে সে তাকে যেন তা খাওয়ায়। (ইবনু মাজাহ ১৪৩৯, ৩৪৪০)।

অসুস্থতা বসত মানুষের সাধারণ খাবার অপ্রিয় লাগতে পারে। অথবা অন্য কোন জিনিসের প্রতি চাহিদা থাকতে পারে। রোগী তা অনেক সময় বলতে পারে না। এজন্য তাকে তার চাহিদার কথাটি জিজ্ঞাসা করা এবং তা বাস্তবায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

রোগীর জন্য দুআ করা

আয়শা বিনতে সা‘দ রা. থেকে বর্ণিত, তার পিতা বলেছেন, আমি মক্কায় কঠিনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি, তখন রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে দেখার জন্য আসেন। … তারপর তিনি আমার কপালের উপর তাঁর হাত রাখলেন এবং আমার চেহারা ও পেটের উপর হাত বুলিয়ে বললেন: হে আল্লাহ! সা‘দকে তুমি নিরাময় কর। তার হিযরত পূর্ণ করতে দাও। আমি তাঁর হাতের হিমেল পরশ এখনও পাচ্ছি এবং মনে করি তা কিয়ামত পর্যন্ত পাব। (সহীহ বুখারী ৫৬৫৯, সহীহ মুসলিম ১৬২৮)।

আয়শা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. এর নিয়ম ছিল, তিনি যখন কোন রোগীর কাছে আসতেন কিংবা তার নিকট যখন কোন রোগীকে আনা হত, তখন তিনি বলতেন: ‘কষ্ট দূর করে দাও হে মানুষের রব! সুুস্থতা দান কর, তুমিই একমাত্র সুস্থতাদানকারী। তোমার সুস্থতা ব্যতীত আর কোন সুস্থতা নেই। এমন সুস্থতা দান কর যা সামান্য রোগকেও অবশিষ্ট না রাখে।’ (সহীহ বুখারী ৫৬৭৫, ৫৭৪৩, ৫৭৫০, সহীহ মুসলিম ২১৯১, আবু দাউদ ৩৮৮৩)।

পাঠক, মোটকথা রোগীর সেবার ভেতর পরকালীন প্রতিদানের পাশাপাশি আছে ইহকালের সামাজিক নিরাপত্তা, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখার এক সফল উপকরণ। অসুস্থ লোকটি রোগে আক্রান্ত হয়ে মানসিকভাবে থাকে দুর্বল, তাই এসময় তাকে দেখতে গেলে, তার পাশে বসে তাকে সান্ত¦নার বাণী শোনালে সে মনের দিক দিয়ে কিছুটা হলেও শক্তি পায়। আর এই বিপদে যে তাকে দেখতে আসে, নিয়মিত খোঁজ খবর রাখে তাকে সে কিছুতেই ভুলতে পারে না কখনো। এটা অনেক পুরনো শত্রু তাকেও মিটিয়ে দেয়।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সুস্থ ব্যক্তি অসুস্থ কোন ব্যক্তিকে দেখলে তার নিজের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। সে নিজের সুস্থতার নিয়ামতের মূল্যায়ন করতে শেখে। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে প্রয়াস পায়। সে বুঝতে পারে আল্লাহ তাকে কত সুখে রেখেছেন। তিনি ইচ্ছে করলে তো এই অসুস্থ রোগীটার স্থানে তাকে রাখতে পারতেন।

ইসলামের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে আমরা অনেক সময় অবহেলা করি। গুরুত্বহীন মনে করি। অথচ এই সামান্য একটু দেখতে যাওয়ার ভেতরে যেমন রয়েছে মহাপুণ্য, তেমনি সামাজিক ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে তা করে তোলে আরো মজবুত শক্তিশালী। সবচে’ বড় ব্যাপার হচ্ছে একজন রোগীকে সেবা করা মানে মহান আল্লাহকে সেবা করা। তাই পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী বা অন্য কোন অসুস্থ মানুষকে সেবা করে আসুন আমরা মহান আল্লাহকে সেবা করার মহাগৌরব অর্জন করি।

লেখক: মুুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
ইমাম: বাইতুল আমান জামে মসজিদ (মেইন বাসস্ট্যান্ড) কালীগঞ্জ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here