ঝিনাইদহঃ

বিজলী খাতুনের আশা ছিল বিয়ের পর স্বামীর সংসারে সুখে দিন কাটাবেন। কিন্তু একমাত্র সন্তান হৃদয় ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছুদিন পর স্বামী বদিয়ার জামান মারা যান। বাধ্য হয়ে বাবার ঘাড়েই বোঝা হন তিনি।

সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল বাবার রোজগারেই চলত হৃদয়ের লেখাপড়া আর পরিবারের সবার ভরণপোষণ। কিন্তু বাবাও সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। নিরুপায় হয়ে নিজেই কাজ খুঁজছিলেন। আর চাকরি পেয়েও যান।

এরই মধ্যে ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের বাকুলিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়েল সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি কারখানা। আর এখানেই বিজলীসহ ১৭ জন অসহায় নারী কাজ করে তাদের সংসার চালান।

দরিদ্র পরিবারের মেয়ে রিপ্তা খাতুন। বিয়ের পর থেকে ছয় বছর ধরে স্বামীসহ শ্বশুর বাড়ির যৌতুক লোভী লোকজনের মুখের গালমন্দ শুনছেন। তাদের আর্থিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। একপর্যায়ে দুই সন্তানের মা হয়েও ছাড়তে হয়েছে স্বামীর সংসার। কোনো দিশা না পেয়ে একজন অসহায় মানুষ হিসেবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে ফুফু বাড়িতে।

শুধু বিজলী, রিপ্তা নয় এমন দুঃখভরা অসহায় জীবনের গল্প শোনালেন রাজিয়া, রুনা, পলি, রোজিনা, পলি, সাকিলা, ময়না, পিংকি, সোনিয়া, মাছুদা, লিপি, রুমি, স্বপ্নাসহ ১৭ জন নারী। যারা সবাই এখন ওয়েল সার্জিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় কাজ করেন।

তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্য সম্মতভাবে তৈরি করছেন সার্জিক্যাল চিকিৎসায় ব্যবহৃত কটন, গজ, ব্যানডেজ, প্যাড, সিজার বেল্ট, মাথাব্যথায় ব্যবহৃত কোর সেট বেল্ট, গলার বেল্ট, আর্ম সেলিং ব্যান্ডেজসহ মানবদেহের বাহ্যিক চিকিৎসা সংক্রান্ত ১৪ প্রকার জিনিসপত্র।

এখানে কোনো নারী বিভিন্ন প্রকার বেল্টের কাপড় কাটছেন, কেউ সেলাই, কেউ তৈরি জিসিপত্রের প্যাকিং করছেন। অন্যদিকে কেউ ঘুরে ঘুরে কাজ তদারকি করছেন। আবার তৈরি জিনিসপত্র বাজারজাত করতে কার্টুন ভরে নিচ্ছেন মার্কেটিংয়ে নিয়োগ প্রাপ্তরা। ফলে সবাই যেন নিজ নিজ কাজে মহাব্যস্ত।

কর্মরত শাকিলা খাতুন বলেন, স্বামীর সংসারে সম্পদ বলতে তেমন কিছু না থাকায় অভাব খুব কাছ থেকে দেখেছি। এরপর এখানে কাজ পেয়ে যা বেতন পাচ্ছি তা দিয়ে এখন সংসার চলে।

তিনি বলেন, এতদিন হতাশার মধ্যে দিন কাটতো। এখন অন্তত দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বাঁচতে পারি।

রোজিনা খাতুন বলেন, সারাবছর সাংসারিক অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন চলতো। এখানে কাজ পেয়ে প্রতি মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি। যা দিয়ে সংসার চলছে।

প্রতিষ্ঠানের সহকারী ব্যবস্থাপক বাহারুল ইসলাম বলেন, এখানে কাজ করা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ নারীরাই এসব জিনিস তৈরির আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। ঢাকা থেকে অভিজ্ঞদের এনে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন তারা নিখুঁতভাবে কাজ করছেন।

তিনি আরো বলেন, এখানে তৈরি জিসিপত্র খুলনা বিভাগের বেশিরভাগ জেলায় বাজারজাত করা হচ্ছে। গুণগত দিক ভালো হওয়ায় ক্রমেই মার্কেটে মালের চাহিদা বাড়ছে।

বাহারুল ইসলাম বলেন, শুধু মুনাফা অর্জনই আমাদের মূল লক্ষ্য না। সমাজের যেসব নারীরা বেশি হতদরিদ্র, যাদের কাজ খুব প্রয়োজন তাদেরই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে মানবদেহের উপকারী জিনিস তৈরি অন্যদিকে এ এলাকার হতদরিদ্র অসহায় নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here