ঢাকাঃ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ডামাডোলের মধ্যেই শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণার সুখবর আসে নেতাকর্মীদের কাছে। সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়—শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। তবে ৬০ জনের তালিকা (আংশিক) দেখে হতচকিত হয়ে পড়েছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।

তাদের ভাষ্য, যে আটটি নিয়ম বেঁধে দিয়ে ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, পূর্ণাঙ্গ কমিটির ক্ষেত্রে এর দু’টি নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছে। আর লন্ডনে অবস্থানরত সংগঠনের অভিভাবক তারেক রহমানের অনুমোদন পাওয়ার পর কমিটি হওয়ায় হতাশাগ্রস্তরা নিজেদের বঞ্চনা প্রকাশ্যে আনতেও পারছে না। যে কারণে পদবঞ্চনার পরও মনোবেদনা আড়াল করতে হচ্ছে তাদের। ছাত্রদলের ৬০ জনের কমিটিতে জায়গা পাওয়া ও বাদপড়া ১৫-১৬ জন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাদের এমন উদ্বেগের তথ্য কথা গেছে।

ছাত্রদলের নেতারা জানান, গত ১৯ সেপ্টেম্বর সরাসরি নির্বাচনে সংগঠনের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল নির্বাচিত হন। এরপর ২০ ডিসেম্বর  কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়। ওই দিন রাতে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী  সাংগঠনিক নেতা বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন্দ্রীয় সংসদের  আংশিক কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন। শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে।

এই প্রসঙ্গে বর্তমান আংশিক কমিটির অন্তত ১০ জন নেতা মনে করেন, তারা নিজেরা যেমন উপযুক্ত পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি মূল সংগঠন বিএনপিও অন্তত ডজনখানেক ত্যাগী নেতা হারিয়েছে।

বর্তমান কমিটির একজন নেতা বলেন, ‘‘২৮ বছর পর সরাসরি নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হাতে এমন অনির্বাচিত, ‘স্ববিরোধী’ কমিটি এসেছে।’’ ‘এ কমিটির রাজনৈতিক লক্ষ্য কী’—এমন প্রশ্ন এখন ছাত্রদলের উদ্বিগ্ন দুই নেতার।

ছাত্রদলের কমিটি হওয়ার পর ২০ ও ২১ ডিসেম্বর সংগঠনটির অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের প্রত্যেকেই এ কমিটি নিয়ে হতাশ। বিষয়টি স্পর্শকাতর বিবেচনা করে সাংগঠনিক নানা চাপ তৈরির আশঙ্কার কারণে নিজেদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে তারা অনীহা প্রকাশ করেছেন।

হতাশার কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন—সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ‘ভাই-গ্রুপ’, ‘এলাকাভিত্তিক ইজম’ । তার এই  নির্বাচনপদ্ধতিরও সমালোচনা করেছেন। প্রধানত, ছাত্রদলে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিধি ছিল, যে প্রার্থী অন্তত ১০ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হবেন, তাকে পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হবে না। আর এই নিয়মটি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। তা অনুমোদন দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর এই ৬০ জনের বিতর্কিত তালিকাটিও এসেছে লন্ডন থেকেই। 

ছাত্রদলের শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, লিখিতভাবে না হলেও সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের নিয়মগুলোকে কঠোরভাবে প্রতিপালন করার কারণেই বিবাহিতদের বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই বাদপড়াদের মধ্যেই ছাত্রদলের মূল নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এমনকি সর্বশেষ যে গুরুত্বপূর্ণ দশজনকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের সেই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারেও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

নতুন কমিটিতে জায়গা পাওয়া কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, কমিটি গঠনে কয়েকটি জায়গায় নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচনি নীতিমালায় প্রত্যেক প্রার্থীকেই মোট ভোটের অন্তত ১০ শতাংশ পাওয়ার শর্ত ছিল। বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনও প্রার্থী কাস্টিং ভোটের ১০ শতাংশ না পান, তাহলে পরবর্তী কমিটিতে কোনোভাবেই তিনি অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।’

ছাত্রদলের নেতারা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে সাঈফ মাহমুদ জুয়েলকে, যিনি সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৬ ভোট পেয়েছেন। সহ-সভাপতি (৫) করা হয়েছে হাফিজুর রহমান হাফিজকে, নির্বাচনে তার প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭। মাজেদুল ইসলাম রুম্মনকে করা হয়েছে সহ-সভাপতি (৮), নির্বাচনে তার প্রাপ্ত  ভোট ছিল ২। সাজিদ হাসান বাবুকে (১২) সহ-সভাপতি করা হয়েছে, নির্বাচনে তিনি মাত্র ৪ ভোট পেয়েছিলেন। ৩৪ ভোট পেয়ে মাহমুদুল হাসান বাপ্পী মনোনীত হয়েছেন সহ-সভাপতি (১৩)। সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১০ ভোট পেয়েছিলেন মামুন খান, তিনি হয়েছেন ৬ নম্বর সহ-সভাপতি।

ছাত্রদলের ৬০ জনের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচনে ৭ ভোট পেয়ে তানজিল হাসান ও ৩ ভোট পাওয়া এবিএম মাহমুদ আলম সরদার যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন। এছাড়া, সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হয়েছেন ডালিয়া রহমান (৮ ভোট), সাখাওয়াত হোসেন (৩ ভোট), সাদিকুর রহমান সাদিক (৭ ভোট)।

ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক দায়িত্বশীল জানান, নতুন কমিটির ৬০ জনের তালিকায় থাকার মতো অনেক নেতাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—আবু তাহের, তানভীর রেজা জুয়েল, আবুল হাসান চৌধুরী, এরশাদ খান, শেখ আল ফয়সাল, মুজাহিদ আলম জাহিদ, নাশিদ আলম, দীপু পাটোয়ারী, কামরুজ্জামান আসাদ, রুকনুজ্জামান, রাকিবুল আলম রাকিব।

কমিটিতে কয়েকজন বিবাহিতকে জায়গা দিলেও ত্যাগী নেতা হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ নিজামউদ্দিন, কে এম নাজমুল আলম, শহীদ মল্লিক, শাফি, আশ্রাফ জালাল মনন, হাবিবুল বাশারকে রাখা হয়নি।

ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক নেতা জানান, নতুন কমিটিতে সহ-সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহইয়াকে। এক-এগারোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পক্ষ থেকে ৫ দফা দাবি তোলাসহ ওই সময় সক্রিয় থাকলেও তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক (চট্টগ্রাম বিভাগীয়) একজন থাকলেও চট্টগ্রাম জোন থেকে মাত্র আবু আফসানকেই রাখা হয়েছে কমিটিতে।

ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে জায়গা পাওয়া একনেতার অভিযোগ, আজিজুল হক সোহেলকে সহ-দফতর সম্পাদক করা হলেও দফতর সম্পাদক পদটি খালি রয়েছে। এ পদে এখনও কাজ করছেন গত কমিটির দফতর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী। নতুন কমিটি গঠনে তার প্রভাব ছিল বলেও অভিযোগ করেন এই নেতা।

ভারতে চিকিৎসাধীন আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী বলেন, ‘কেন দফতর সম্পাদক দেওয়া হয়নি, এটা আমি বলতে পারবো না। ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তালিকা পাঠানোর পর সাংগঠনিক অভিভাবক তারেক রহমান অনুমোদন করেছেন। এখানে আমার কোনও ভূমিকা নেই, থাকার প্রশ্নই আসে না।’

সংগঠনের একাধিক নেতা দাবি করেন, মূলত নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আংশিক কমিটির যে তালিকা লন্ডনে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলেন, সেই তালিকাই পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খোদ ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন। কমিটিতে তার অনুসারীদের কোনও জায়গাই দেওয়া হয়নি। উপরন্তু সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানের অনুসারী বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাসান শ্যামলের অসংখ্য অনুসারী নেতা পেয়েছেন পদ।

ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান কমিটির একাধিক নেতার দাবি, লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের আশেপাশে যে ক’জন কাজ করেন, তাদের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেটটিই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বিভ্রান্ত করেছে। যাদের মধ্যে অধুনালুপ্ত হাওয়া ভবনের ব্যক্তিরাই উল্লেখযোগ্য বলেও এই নেতারা অভিযোগ করেন।

ছাত্রদলের নতুন কমিটিকে কেন্দ্র করে  তোলা অভিযোগ নিয়ে  জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, ‘আইন তো মানুষের জন্য। সংগঠনের জন্যই নিয়ম, নিয়মের জন্য সংগঠন নয়। যারা কাস্টিং ভোটে দশ শতাংশ ভোট পাননি কিন্তু নির্বাচন করেছেন, তারা তো বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় পুরোটাই চষে বেড়িয়েছেন। ছাত্রদলের হালহাকিকত তারা বলতে পারবেন।’

ইকবাল হোসেন শ্যামল এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘যারা নির্বাচন করেছেন, তারা প্রত্যেকেই সংগঠনের সামগ্রিক হাল সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। ফলে, তাদের নিয়ে কমিটি করায় সারাদেশে কাজে লাগানো যাবে। ওই কারণেই আমাদের নেতা তা শিথিল করেছেন।’ এটি সংগঠনের স্বার্থে করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here