ফারুক নোমানীঃ

ভালোবাসা হৃদয়ের এক কোমল অনুভূতি। ভালোবাসা বিনে মানুষ বাঁচতে পারে না। শুধু মানুষ কেন অন্য প্রাণীরাও চলতে পারে না তা ছাড়া। এই প্রীতি ভালোবাসা, স্নেহ মমতার কল্যাণেই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। মানবপ্রজন্ম ও প্রাণীকুল পৃথিবীর শোভাবর্ধন করছে।

একজন মা দশ মাস পর্যন্ত সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে। এ সময়টিতে তিনি না পারেন ঠিকমত খেতে আর না পারেন প্রয়োজনমত ঘুমাতে। অন্তসত্ত্বাকালীন কত রাত তাঁর পার হয় নির্ঘুম জেগে জেগে। সন্তান প্রসবের সময়টি তাঁর জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি একটি সময়। কত মা তো প্রসববেদনা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুবরণও করেন। শীতের রাতে বাচ্চা পেশাব করে বারবার কাপড় ভিজিয়ে দেয়, তবুও মায়ের কোন অভিয়োগ নেই। নেই কোন অভিমান। বরং পরম মমতাভরে তিনি সকল কষ্টই অম্লান বদনে মেনে নেন, শুধু ভালাবাসার টানেই। একজন পিতা সারাদিন কর্মস্থলে কঠোর পরিশ্রম করেন তার সন্তানদের জন্য। ঝড়বাদল, রোদবৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে তিনি রোজগার করেন সন্তান ও পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে। এতে তাঁরও নেই কোন ক্ষোভ, কোন অভিযোগ। সেখানেও ভালোবাসার মহিমা ফুটে ওঠে স্বগৌরবে। আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের কথা বাদই দিলাম, একটি চতুষ্পদ প্রাণী গরু বা ছাগলের কথা ভাবুন, কত যত্নে সে তার বাছুর ও ছানাকে আগলে রাখে। অথবা একটি পাখির দিকে তাকান, বা আপনার বাড়ির মুরগীর কথা চিন্তা করুন! মা পাখিটি তার বাচ্চাকে দুই ডানা দিয়ে নিরাপদে রাখে সকল অনিষ্ট থেকে। বনবিড়াল, বেজি, শিয়াল বা এজাতীয় হিংস্র প্রাণীর হামলা থেকে বাচ্চাদের জীবন বাঁচাতে একটি মুরগী শরীরের সবটুকু শক্তি ব্যয়ে ঝাপিয়ে পড়ে হামলাকারীর ওপর। বাচ্চাদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে কখনো তো নিজের জীবনই উৎসর্গ করে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি। বলতে পারেন, কিসের ভিত্তিতে সে এই সংগ্রাম করে? ভালোবাসার টানে। ভালোবাসার দাবিতেই সে সন্তানদের জীবন রক্ষার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। তাহলে সহজে বলা যায়- সৃষ্টির সেরা মানুষের মাঝে যেমন আল্লাহ ভালোবাসা দিয়েছেন, একইভাবে এই ভালোবাসা ও স্নেহের বন্ধন তৈরি করেছেন তিনি অন্যান্য সৃষ্টির ভেতরেও। এই ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত। তাঁর দেয়া একটি বড় নেয়ামত। যার প্রতিচ্ছবি দেখি আমরা প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বুকে। তবে যিনি ভালোবাসার সৃষ্টি করেছেন, প্রাণীদের মাঝে যিনি ভালোবাসা দিয়েছেন, তিনি কতটা ভালোবাসেন মানুষকে তা একটি হাদীস দেখলেই বুঝা যাবে। সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ তাঁর রহমতকে একশ’ ভাগ করে নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখেছেন এবং একভাগ পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। (সহীহ মুসলিম ৬৭১৯)

তাঁর থেকে অন্য আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, নবীজী সা. বলেছেন- ‘আল্লাহর একশ’ ভাগ রহমত আছে। তন্মধ্যে একভাগ রহমত মানুষ, জীন, চতুষ্পদ জন্তু ও কীট-পতঙ্গের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। এ একভাগ রহমতের কারণেই সৃষ্টিজীব পরস্পর একে অপরের প্রতি অনুগ্রহ করে এবং এ একভাগ রহমতের ভিত্তিতেই বন্য পশু নিজ সন্তানের প্রতি অনুগ্রহ ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে।’ (সহীহ মুসলিম ৬৭২১)

পাঠক, একটু চিন্তা করুন! একশ’ ভাগ রহমত বা ভালোবাসার ভেতরে শুধু একভাগ তিনি পৃথিবীর সূচনাকাল থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ, জীন, চতুষ্পদ প্রাণী ও কীট-পতঙ্গ আছে সবার মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন। বাকী নিরানব্বই ভাগ রেখেছেন নিজের কাছে। একভাগের কারণে যদি সৃষ্টিজীব একে অপরকে এতোবেশি ভালোবাসতে পারে, তবে নিরানব্বই ভাগ ভালোবাসা যিনি নিজের কাছে রেখেছেন তিনি এই মানুষকে কতটা বেশি ভালোবাসেন তা সহজেই অনুমেয়। মহান আল্লাহ মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, তাই তাকে করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। তাকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ মর্যাদা। এ সম্পর্কই তিনি বলেন-‘নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা ইসরা ৭০)

মহান আল্লাহ আশরাফুল মাখলুকাত এই মানুষকে বড় ভালোবেসে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। তাই আকাশের চাঁদের যে সৌন্দর্য আছে, বাগানের ফুলেরও আছে যে নয়নাভিরাম শোভা। সকল শোভা-সৌন্দর্যের থেকে উত্তম সৌন্দর্য দিয়ে আল্লাহ মানুষকে বানিয়েছেন। সেকথাই তিনি বলেছেন কুরআনে -‘শপথ আঞ্জির ও যায়তুনের এবং সিনাই মরুভূমির পাহাড় তূরের এবং এই নিরাপদ শহরের,আমি মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। (সূরা তীন: ১-৪) আল্লাহর জন্য কোন বস্তুর শপথ করে কোন কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তিনি যা বলবেন এটাই চূড়ান্ত। তারপরও তৎকালীন আরবের মানুষেরে মধ্যে বহুল আলোচিত সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ চারটি বস্তুর কসম করে তিনি বলেছেন, আমি মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। সুতরাং মানুষের ভেতরেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ সৌন্দর্য বিকশিত হয়েছে।

মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির অনন্য সৌন্দর্য:

মানুষসৃষ্টির বিষয়ে আল্লাহ কুরআনে অনেক জায়গায় নানাভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘নিশ্চয় আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির উপাদান হতে। অতঃপর আমি ওকে শুক্রবিন্দু রূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে (জরায়ুতে)। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি রক্তপিণ্ডে, অতঃপর রক্তপিণ্ডকে পরিণত করি গোশতপিণ্ডে এবং গোশতপিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপঞ্জরে; অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে ঢেকে দিই গোশত দ্বারা; অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টিরূপে; অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান!’ (সুরা আল মুমিনুন ১২-১৪)

এখানে মানুষকে মাটির উপাদান হতে সৃষ্টি করার অর্থ সর্বপ্রথম মানুষ আদি পিতা আদম আ.কে মাটি হতে সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা মানুষ যা কিছু খাদ্য হিসাবে ভক্ষণ করে থাকে (এবং তার ফলে বীর্য তৈরী হয়), তা মাটি হতেই উৎপন্ন, সেই হিসাবে শুক্রবিন্দুর মৌলিক উপাদান; যা মানুষ সৃষ্টির কারণ, তা হল মাটি।

পরের আয়াতে নিরাপদ আধার বা স্থান বলতে মায়ের গর্ভাশয় বা জরায়ু বুঝানো হয়েছে, যেখানে বাচ্চা ৯-১০ মাস নিরাপদে লালিত-পালিত হয়ে থাকে।

শেষ অংশের প্রতি লক্ষ করুন, মহান আল্লাহ কত সুন্দর করে মায়ের গর্ভের শুক্রবিন্দুকে পরিণত করেন রক্তপিণ্ডে, এরপর রক্তপিণ্ডকে রূপান্তরিত করেন গোশতপিণ্ডে। গোশতপিণ্ডকে তিনি পরিণত করেন অস্থিপঞ্জরে। এরপর এই অস্থিপঞ্জর বা হাড়কে ঢেকে দেন গোশত দ্বারা। অবশেষে তাকে এক অনন্য সৃষ্টি হিসেবে গড়ে তোলেন। গোশতপিণ্ড-কে অস্থিতে পরিণত করার উদ্দেশ্য মানুষের কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করানো। কারণ, শুধু মাংসের মধ্যে শক্তি ও কঠিনতা নেই। আবার যদি কেবলমাত্র অস্থি-পঞ্জরের খাঁচা (কঙ্কাল)টা রাখা হত, তাহলে মানুষের সেই শোভা ও সৌন্দর্য প্রকাশ পেত না, যা প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। এ কারণে সেই হাড়ের উপর এক বিশেষ নিয়মে ও প্রয়োজন মাফিক গোশত চড়ানো হয়েছে; কোথাও কম, কোথাও বেশি। যাতে মানুষের দৈহিক গঠনে কোন ধরনের অসামঞ্জস্য ও অসৌন্দর্য প্রকাশ না পায়; বরং সে রূপ ও সৌন্দর্যের এক সুশোভন অবয়ব এবং আল্লাহর সৃষ্টির এক সুন্দর নমুনা হয়। এই কথাটিই কুরআনের সূরা তীনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয় আমি সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।’

অন্যত্র এ সম্পর্কে আরো আলোচনা হয়েছে। আল্লাহ বলেন- ‘হে মানুষ! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহে থাক তবে নিশ্চয়ই জেনে রাখ, আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর শুক্র থেকে, তারপর জমাট রক্ত থেকে, তারপর পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট অথবা অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট গোশত থেকে। তোমাদের নিকট বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করার নিমিত্তে। আর আমি যা ইচ্ছা করি তা একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে অবস্থিত রাখি। অতঃপর আমি তোমাদেরকে শিশুরূপে বের করি, পরে যাতে তোমরা যৌবনে উপনীত হও। তোমাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু দেয়া হয় এ বয়সেই, আবার কাউকে কাউকে ফিরিয়ে নেয়া হয় হীনতম বয়সে, যাতে সে জ্ঞান লাভের পরও কিছু না জানে। তুমি যমীনকে দেখতে পাও শুষ্কাবস্থায়, অতঃপর যখনই আমি তাতে পানি বর্ষণ করি, তখন তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয় এবং উদগত করে সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ।’ (সূরা হজ ৫)

সহীহ হাদীসেও এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, সাদিকুল মাসদূক (সত্যপরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠরূপে প্রত্যায়িত) রাসুলুল্লাহ সা. আমাদের হাদীস শুনিয়েছেন যে, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টি (শুক্র) তার মাতৃ উদরে চল্লিশ দিন জমাট থাকে। এরপর অনুরুপ চল্লিশ দিনে রক্তপিণ্ডে পরিণত হয়। এরপর অনুরুপ চল্লিশ দিনে তা একটি গোশত পিণ্ডের রুপ নেয়। এরপর আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে একজন ফিরিশতা পাঠানো হয়। সে তাতে রুহ ফুঁকে দেয়। আর তাঁকে চারটি বিষয় লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর তা হল এই- তার রিযক, তার মৃত্যুক্ষণ, তার কর্ম এবং তার বদকার ও নেককার হওয়া। (সহীহ মুসলিম ৬৪৮২)

মানুষের প্রতি আল্লাহর অবারিত নেয়ামত:

মানুষের প্রতি আল্লাহর দয়ার কোন শেষ নেই। একটি মানব শিশুর জন্মের জন্য কত ব্যবস্থাপনা তিনি সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। গর্ভজগতে তিনি কত আয়োজন করে রেখেছেন একটি মানবসন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য। আমরা তা কখনো কল্পনাও করি না। মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃ জঠরের তিনটি পর্দা বা স্তর সৃষ্টি করেছেন দয়াময় আল্লাহ তা‘য়ালা। যথা- পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রুণের আবরণ বা ভ্রুণের ঝিল্লি গর্ভফুল ( Placenta)। এই তিন স্তর সম্পর্কে মহান আল্লাহ কুরআনে বলেন- ‘তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে’ (সুরা যুমার ৬)।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কুরআনে যে ‘ত্রিবিধ অন্ধকারের’ কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি অন্ধকার হল- ১. রেহেম ২. মাশীমা বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট।

রেহেমে রক্তপিণ্ড ব্যতীত সন্তানের আকার-আকৃতি কিছুই তৈরী হয় না। আর গর্ভফুল (Placenta) ভ্রুণ বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখে। গর্ভফুল মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে নানা পুষ্টি ভ্রুণের দেহে বহন করে, খুব ধীর গতিতে রেচন পদার্থ মায়ের দেহের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। গর্ভফুলের সাহায্যে ভ্রুণ অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগ করে মায়ের ফুসফুসের মাধ্যমে, জীবাণু (Infection ) থেকে ভ্রুণকে রক্ষা করে। এছাড়া ভ্রুণটি ঠিকমত জরায়ুতে আটকে রাখা, পুষ্টি সঞ্চয়, সম্পর্ক রক্ষা, হর্মোন সৃষ্টি ইত্যাদি কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

একটু চিন্তা করুন, আল্লাহ মানবসন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য গর্ভফুলের ভেতর দিয়ে মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে নানা পুষ্টি তার শরীরে সরবরাহ করেন। আবার তার অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বনডাই অক্সাইড ত্যাগ করার ব্যবস্থা করেছেন এই গর্ভফুলের মাধ্যমে। কতটা নিখুতভাবে তিনি এই ব্যবস্থাপনা করেছেন!

এভাবে ভ্রুণটি জরায়ুতে বেড়ে উঠতে থাকে ও ১২০ দিন অতিবাহিত হলে শিশুর রূহ ফুঁকে দেয়া হয়। আর শিশু নড়েচড়ে উঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে। সবচেয়ে মজার কথা হল মানবশিশুর যে অঙ্গ সর্বপ্রথম গঠিত হয় তা হল কর্ণ। আর সন্তান গর্ভে ধারণের ২১০ দিন পর চক্ষু গঠিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়।

আর সন্তানটির যখন ভূমিষ্ঠ হবার উপযুক্ত সময় হয়ে যায়, তখন Overy-Placenta থেকে এক প্রকার গ্রন্থিরস নিঃসৃত হয়, যা প্রসব পথ পিচ্ছিল ও জরায়ুর মুখ ঢিলা করে দেয়।

আল্লাহ বলেন-‘সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি। আমি কি দেইনি তাকে দু’টি চোখ? এবং জিহবা ও দু’টি ঠোঁট? আর আমি তাকে দেখিয়েছি দু’টি পথ।’ (সুরা বালাদ ৭-১০)

অন্যত্র আল্লাহ অবিশ্বাসী মানুষের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-‘মানুষ ধ্বংস হোক! সে কত অকৃতজ্ঞ! তিনি তাকে কোন বস্তু থেকে সৃষ্টি করেছেন? শুক্রবিন্দু থেকে তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর তাকে করেছেন সুপরিমিত। তারপর তার জন্য পথ সহজ করে দিয়েছেন।’(সূরা আবাসা ১৭-২০)

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় ক্ষমতা-বলে মাতৃগর্ভে মানুষকে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনিই তার অপার শক্তির মাধ্যমে মাতৃগর্ভ থেকে জীবিত ও পুর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে বাইরে আসার পথ সহজ করে দেন। ফলে দেহটি সহী-সালামতে বাইরে চলে আসে এবং মায়েরও এতে তেমন কোন দৈহিক ক্ষতি হয় না।

পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবার পর আল্লাহ মায়ের বুকে সন্তানের জন্য দুধের ব্যবস্থা করেন। এটা শিশুর জন্য এমন খাবার যার কোন বিকল্প নেই। মানবশিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় সকল উপাদান তিনি মায়ের দুধে রেখেছেন। এমন দুধ যা বেশি গরমও না,আবার বেশি ঠাণ্ডাও না। বেশি মিষ্টিও না আবার তিতা বা লোনাও না। কত সুন্দর করে শিশুর উপযোগী খাদ্য তিনি মায়ের বুকে সৃষ্টি করেছেন।

মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আল্লাহর মহিমার প্রকাশক। আমাদের যে অঙ্গটি যেখানে থাকলে সুন্দর দেখাবে সেটাকে আল্লাহ সেখানেই রেখেছেন। কত মূল্যবান সম্পদ আল্লাহ আমাদের দেহে দিয়েছেন, কোন সুস্থ মস্তিষ্কের কোন লোককে যদি বলা হয়, তোমাকে এত টাকা দিব, বিনিময়ে তোমার চোখ দুটো তুলে নিব, বা তোমার হাত দুটো কেটে নিব, কোন সুস্থবিবেকের মানুষ কখনো তাতে রাজি হবে না নিশ্চয়ই। আর এই মূল্যবান অঙ্গগুলো আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে বিনামূল্যে দান করেছেন।

চিন্তা করেছেন কি কখনো, আমাদের মাথার ওজন এক থেকে দেড় কেজি। একটি মাথায় যে মস্তিষ্ক আছে তা গঠিত হয়েছে ১০০ বিলিয়ন নিউরন বা স্নায়ুকোষ দ্বারা! আল্লাহ আমাদের প্রতি কত অনুগ্রহ করেছেন!!

কথার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারা আল্লাহর বড় আরেকটি নেয়ামত। এটা কত বড় নেয়ামত তা বোঝানোর জন্য তিনি কিছু মানুষকে বাকপ্রতিবন্ধী বানিয়েছেন। তাদেরকে দেখে অন্য মানুষ যেন বাকসক্ষমতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। আল্লাহ বলেন-‘রহমান তো তিনি, যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন, তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন।’ ( সূরা আর রহমান: ১-৪)

পৃথিবীতে আমরা যা দেখি তা শুধু মানুষের জন্যই দয়াময় আল্লাহ বানিয়েছেন। তিনি বলেন- ‘তোমরা কি দেখ না নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ তোমাদের কাজে নিয়োজিত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? এমন লোকও আছে; যারা জ্ঞান, পথনির্দেশ ও উজ্জল কিতাব ছড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বাকবিতণ্ডা করে।’ (সুরা লুকমান ২০)

এভাবে একটি একটি করে যদি আমরা আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা হিসেব করি কখনোই তা শেষ হবে না। তাই তো তিনি ঘোষণাই দিয়েছেন-‘যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সুরা নাহল :১৮)

অন্য জায়গায় বলেছেন- ‘যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গণনা করতে চাও তাহলে তাতে সক্ষম হবে না। আসলে মানুষ বড়ই বে-ইনসাফ ও অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ইবরাহীম: ৩৪)

অন্যত্র বলেন-‘অতপর মানুষ তার খাদ্যকেই একটু লক্ষ করুক! আমি উপর থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি। তারপর ভূমিকে বিস্ময়করভাবে বিদীর্ণ করেছি। তারপর আমি তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য। আঙ্গুর, শাক-সব্জি, যয়তুন, খেজুর, নিবিড়-ঘন বাগান, ফলমূল ও ঘাস-পাতা। সবকিছুই তোমাদের নিজেদের ও তোমাদের গবাদি পশুর ভোগের জন্য।’ (সূরা আবাসা: ২৪-৩২)

প্রিয় পাঠক, যে মালিক তার কর্মচারীকে বেতন ভাতা দিয়ে কোন কাজে নিয়োগ করেন, সে যদি মালিকের বেতন খেয়ে তার কাজ না করে মালিক কি তাকে কাজে বহাল রাখবে বা তার বেতন ভাতা দিবে? নিশ্চয় বলবেন, না। এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, আমাদের মালিক দয়াময় আল্লাহ আমাদের প্রতি কত দয়া ও ভালোবাসা দিয়েছেন। সদাসর্বদা আমাদেরকে তাঁর নিয়ামতে তিনি ডুবিয়ে রেখেছেন, কিন্তু আমরা এই মানুষেরা সেই মহান মালিকের কতটুকু বিধান পালন করতে পারছি! তাঁর ভালোবাসার কতটুকু সম্মান দেখাতে পেরেছি? কৃতজ্ঞতাই বা প্রকাশ করেছি কতটুকু…

লেখক: ইমাম, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মেইন বাসস্ট্যান্ড কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here