যশোরঃ

‘খুব মনে পড়ছে তাদের কথা। পরীক্ষার দিন সকালেও আমরা একসঙ্গে ছিলাম। কথাও হয়েছে। পরীক্ষার পরে আমরা সবাই মিলে একটু পিকনিকের মতো আয়োজনের কথাও বলেছিলাম। সবাই একসঙ্গে মিলিত হতে আমাদের কর্মসূচিও ছিল। কিন্তু কোথা থেকে কী যে হয়ে গেলো! স্বপ্নগুলো নিমিষেই মিইয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।’  ছয় সহপাঠীকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে আর কোনও শব্দই যেন খুঁজে পেলেন না যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয় শিক্ষার্থী হারুন অর রশিদ।

সরকারি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের (এমএম কলেজ) গেটসহ কলাভবনে টাঙানো রয়েছে শোক ব্যানার। এই শোক তাদের ছয় শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে। গত বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বেলা ৩টার দিকে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কে বাস দুর্ঘটনায় ১২জন নিহত হন। আহত হন আরও ২০ জন। মৃত্যুর এই মিছিলে ছয় জনই এমএম কলেজের মাস্টার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। 

তাদের এই অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক কেউই। কথা বলতে গিয়ে বেদনার্ত কণ্ঠ নিমিষেই আর্দ্র হয়ে উঠছে। দু’চোখ বেয়ে ঝরছে জল।

গত বুধবার মাস্টার্সের পরীক্ষা দিয়ে যার যার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন এমএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ঝিনাইদহ জেলা সদরের নাথকুণ্ডু গ্রামের ওয়াহেদ আলীর ছেলে ইউনুস আলী, কালীগঞ্জ উপজেলার বড় ভাটপাড়া গ্রামের রণজিত কুমার দাসের ছেলে সনাতন কুমার দাস, কোটচাঁদপুর উপজেলার হরিণদিয়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে হারুন অর রশিদ এবং মাস্টার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কালীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের মুস্তাফিজুর রহমান কল্লোল। এছাড়া মাস্টার্স ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের দিংদহ গ্রামের আবদুর রশিদের মেয়ে শারমিন আক্তার রেশমা ও আলমডাঙ্গা উপজেলার নাগদহ গ্রামের জান্নাতুল বিশ্বাসের ছেলে অলিউল রহমান শুভসহ তাদের কয়েকজন ক্লাস মেট। 

নিহতদের ক্লাসমেট সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মীনা বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এখন রোজকার ব্যাপার হয়ে গেছে। রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ির বেপরোয়া চলাচল শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, সাধারণ মানুষের জন্যে বিশাল একটি মৃত্যুফাঁদ। একটি মৃত্যুতে হয়তো সেই মানুষটার জীবনকাহিনী শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তার স্বজনদের জন্য সারাজীবনের কষ্ট।’ 

মীনা জানান, গত বছরের নভেম্বরে যশোর-সাতক্ষীরা সড়কে বাস দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। তার মস্তিষ্কে আঘাত লাগে; নার্ভের সমস্যা সৃষ্টি হয়। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন মাথায় প্রেশার পড়ে, এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে। 

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভারী হয়ে আসা গলায় মীনা বলেন, ‘তারা কেবল ক্লাসমেট ছিল না, ছিল আমাদের পরমবন্ধুও। আমরা হয়তো তাদের মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছি; কিন্তু যাতনা বয়ে বেড়াতে হবে তাদের পরিবারকেই। আর যারা আহত হয়ে বিছানায় রয়েছেন, তাদের সেই যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে সারাটা জীবন।’

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ মিলিত হওয়ার দিন ছিল গত বছরের মার্চ মাসে। সেদিন তারা ক্লাস করেন প্রায় চার ঘণ্টা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসার আগে পরস্পরের সম্মতিতে প্রত্যেকেই যার যার বাড়ি থেকে খাবার আনেন। এরপর নিজেরা সেইসব খাবার ভাগাভাগি করে খান।  সে এক অন্যরকম আনন্দের ক্ষণ ছিল। 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হারুন।  তিনি জানান, নিহতের মধ্যে আরও একজনের নাম হারুন। বুধবার দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই অনেকে তাকে ফোন দিয়ে সুস্থতা খবর জানতে চায়। 

তিনি বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা দ্রুত হাসপাতালে যাই। সেখানে বন্ধুরা শুয়ে রয়েছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কালও একটা পরীক্ষা রয়েছে।  অনেকে হয়তো দিতে পারবে না। দিতে হলে সিক বেডে কিংবা শ্রুতিলেখক নিতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না এমনভাবে আমাদের আর কোনও বন্ধু হারিয়ে যাক। এই মৃত্যুর মিছিলে আর কোনও মানুষ যেন না সামিল হয়।  সেরকম ব্যবস্থা নিতে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করি।’

একটি দুর্ঘটনা নিহতদের পরিবারে বয়ে আনে সারা জীবনের কান্না। এমএম কলেজের ছয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাদের পরিবারের। একেকজনের স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের হাল ধরা। কেউ কেউ পরিবারের হাল ধরেওছিলেন। কিন্তু নানা রঙের স্বপ্নে রঙিন দিনগুলো নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে গেল। প্রিয়জনের চিরবিদায়ে শোকে বিহ্বল পরিবার, স্বজন, বন্ধুরা। সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারও। একই কলেজের ছয় শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যুতে স্তব্ধ-বাকরুদ্ধ শিক্ষকরাও।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হামিদুল হক শাহীন বলছিলেন, ‘আমি তাদের সরাসরি ক্লাসে পড়িয়েছি, পুরো কোর্স করিয়েছি। এই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না। আমি বলি, এটি একটি হত্যা। এগুলো মেনে নেওয়া যায় না।’   

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. এম হাসান সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পেয়েই কলেজ প্রিন্সিপ্যালসহ অন্য শিক্ষকদের অবহিত করি। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ শিক্ষার্থীদের জানাই যেন রক্ত বা ওষুধ সরবরাহে কোনও সমস্যা না হয়। এরপর আমরা দুর্ঘটনায় নিহত চার শিক্ষার্থীর বাসায় যাই। সেখানে তিন শিক্ষার্থীর সৎকারে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়া, গুরুতর আহত একজন শিক্ষার্থীকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়।’ 

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ মূলত আমাদের রাস্তাগুলো সরু আর যানবাহন বেশি। যানবাহন আবার বেশিরভাগই ফিটনেসবিহীন। এছাড়া অদক্ষ চালক, সড়কে প্রতিযোগিতামূলক চলাচলই এসব দুর্ঘটনার কারণ। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বলতে চাই, আপনারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করুন, দুর্ঘটনারোধ করুন।’

সরকার যে ছয় লেনের চিন্তা করছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন হলে সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।   

জানতে চাইলে অধ্যক্ষ প্রফেসর আবদুল মজিদ বলেন, ‘একটি দুর্ঘটনায় এত সংখ্যক শিক্ষার্থী মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। কিন্তু এই শোকে সান্ত্বনা জানানোর ভাষা নেই। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই নিহতদের বাড়িতে গিয়েছি। পারিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়েছি। তাদের সৎকারে আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। একই সঙ্গে কলেজের উদ্যোগে আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ সবসময় তাদের পাশে আছে। নিহতদের স্মরণে শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) কলেজ মসজিদে দোয়া মাহফিল হবে। পরবর্তীতে স্মরণসভার আয়োজন করা হবে।‘

প্রসঙ্গত, বুধবার বিকালে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার এলাকায় যশোর থেকে মাগুরাগামী জিকে পরিবহনের একটি বাস বিপরীত থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে যাত্রীবাহী বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ওপর আড়াআড়ি হয়ে উল্টে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই ৯ জন ও পরে হাসপাতালে আরও তিন জন মারা যান। আহত হন অন্তত ২০ জন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here