বিশেষ প্রতিনিধি:

সদ্য ঘোষিত ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে তৃণমুলে ক্ষোভ আর অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে এই কমিটিকে সভাপতি ও সম্পাদকের পকেট কমিটি বলেও আখ্যায়িত করেছেন। ব্যাপক অনিয়ম, সেচ্ছাচারিতা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫ সেপ্টেম্বর জেলা কমিটির তালিকা সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে প্রকাশের পর পদ বঞ্চিত নেতা ও সংগঠনকে ভালোবাসে এমন মানুষ নেতাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তুলেছে।

অনেকে ২৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস ও ব্যবসা বানিজ্য করেন কোন দিন আন্দোলন সংগ্রাম মিছিল মিটিং এ দেখা যায়নি এমন ব্যক্তিও জেলা কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। আবার বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের মিছিল মিটিংয়ে সরব এমন ব্যক্তিকেও জেলা বিএনপির কমিটিতে রাখা হয়েছে বলে মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ। অথচ যে সব নেতা কর্মীরা বিএনপি দল করেন এবং আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে লড়া করে আসছে তাদের কমিটিতে রাখা হয়নি। অনেক নেতা শাসক দলের হামলা, মিথ্যা মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দুই ডজন মামলা মাথায় নিয়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে আজ পথের ফকির। অনেকে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য জেলা শহরে রিকসা ভ্যান ইজিবাইক চালিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন।

জানা গেছে, আনোয়ারুল ইসলাম বাদশা কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার জেলা কৃষক দলেরও আহবায়ক। তাকে আবার সদ্য ঘোষিত জেলা কমিটির সহ- সভাপতি করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান জিয়া মহেশপুর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহেশপুর থানা যুবদলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকেও জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। কামরুজ্জামান লিটন জেলা জাসাসের সাধারন সম্পাদক ও সদর থানা বিএনপির সহ সাধারণ সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাড: এম এ মজিদের ব্যবসায়ীক পার্টনার মোঃ শাহিন খাঁন আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান সদর উপজেলার কালিচরনপুর ইউনিয়ন বিএনপির সদস্য, সদর থানা বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক। তাকেও জেলা বিএনপির সহ দপ্তর সম্পাদক বানানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০০৩ সালে হাফিজ চেয়ারম্যানের সাথে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন শাহিন খান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোঃ সফিকুল ইসলাম অপুর সাথে নির্বাচনী মাঠে বিএনপি নেতা কর্মীদের চরম নির্যাতন করেছেন। গত ৩ বছর আগে জেলা বিএনপির সভাপতির পার্টনার হওয়ার পরেও তিনি আওয়ামী লীগের সভা সমাবেশে সরব ছিলেন। তিনি এখনও বিএনপিতে যোগদান না করেই সভাপতির ব্যবসায়ীক পার্টনার হিসাবে প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির একাধিক পদ নিয়েছেন। আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কালিচরনপুর ইউনিয়নে বিএনপি থেকে তাকে নমিনেশন দেওয়া হবে বলে তিনি ইউনিয়ন এলাকায় শুভেচ্ছা জানিয়ে পোষ্টার টাঙিয়ে রেখেছেন। কলেজের প্রভাষক কামাল উদ্দিন জেলা বিএনপির সহ সম্পাদক ছাড়াও জেলা জিয়া পরিষদের সভাপতি ও হরিনাকুণ্ডু থানা বিএনপির সদস্য। প্রভাষক এম আক্তারুজ্জমান মুকুল নিজ উইনিয়নের সদস্য, থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক তাকেও জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক করা হয়েছে। যুব নেতা আশরাফুল ইসলাম পিন্টু সদ্য ঘোষিত জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক হয়েছেন। কিন্তু তিনি এর আগেই জেলা যুব দলের সাধারণ সম্পাদক ও হরিনাকুন্ডু থানা বিএনপির সদস্য হিসেবে রয়েছেন। শৈলকুপার উসমান আলী জেলা বিএনপির সহ সভাপতি, শৈলকুপা বিএনপির সহ সভাপতি ও কেন্দীয় কৃষকদলের সহ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। চেক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন মামলার আসামী এ.কে.এম হারুনুর রশিদ মোল্লার নামে বাংলাদেশে অনেক থানায় মামলা রয়েছে। তাকেও কালীগঞ্জ থানা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক, কৃষকদলের নির্বাহী সদস্য ছাড়াও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন। এছাড়াও এই হারুন মোল্লা এলাকায় শতাধিক মানুষের কাছ থেকে ইটভাটার অগ্রীম টাকা নিয়ে লাপাত্তা। কখনো এলাকায় আসেন না। প্রভাষক জাহাঙ্গীর হোসেন সদর থানা বিএনপির সদস্য ও জেলা জিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে।

কালীগঞ্জের সাইফুল ইসলাম ফিরোজ কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এই নেতাকেও জেলা বিএনপির নুতন কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে। প্রভাষক আব্দুল খালেক ঝিনাইদহ সদর থানা বিএনপির ২নং যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আবার পাগলাকানাই ইউনিয়ন বিএনপিরও সদস্য। তাকে জেলা বিএনপির তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক করা হয়েছে। ডাকবাংলার আলাউদ্দিন আল মামুন সাগান্না ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বে আছেন। তিনি আবার সদর থানা বিএনপির সদস্য। তাকে জেলা বিএনপির সহ সভাপতি করা হয়েছে। এ্যাড মুন্সি কামাল কামাল আজাদ পান্নু সদর থানা বিএনপির সভাপতি। তাকেও জেলা বিএনপির সহ সভাপতি করা হয়েছে। থানা বিএনপির সাধারন সম্পাদক আলমগীর হোসেন চেয়ারম্যান ও ঝিনাইদহ পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শেখরও একাধিক পদে রয়েছেন। তাদের ও জেলা বিএনপির নির্বাহী সদস্য করা হয়েছে। পল্লি বিদ্যুতের ঠিকাদার ইঞ্জনিয়ার শাহিন নামে এক ব্যক্তি ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী মঞ্চে উঠে যোগদান করেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ পৌরসভা নির্বাচনের সময় তার নিজস্ব ব্যবসায়ীক অফিসে নৌকার প্রচার অফিস বানিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট করেন। তাকেও বিএনপির নতুন কমিটির কোষাধ্যক্ষ পদ দেওয়া হয়েছে। লোকমান হোসেন পৌর বিএনপির ২নং সাংগঠনিক সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। মনিরুজ্জামান খান মিঠু পৌর বিএনপির ১নং যুগ্ম সম্পাদক। তাকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনার শ্যালক মহেশপুরের জাহিদ হিরনকে ইউনিয়ন কমিটি, থানা বিএনপির ও সর্বশেষ জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। জাহিদ হিরনের গোটা পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

ঢাকার উত্তরার জনৈক শাহিনকে জেলা বিএনপির সদস্য করা হয়েছে। তিনি সভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ মজিদের ঢাকার প্রতিবেশি। কোটচাঁদপুরের আব্দুর সবুর খান ২৫ বছর ধরে ঢাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। সভাপতি মজিদের ব্যবসায়ীক পার্টনার হওয়ার কারণে তিনিও জেলা বিএনপির শিল্প ও বানিজ্য বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন।

অন্যদিকে মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত সাবেক কেসি কলেজের জিএস ও জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এ্যাড আব্দুল আলীম জেলা বিএনপির সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতা করে পরাজিত হন। তার মতো একজন নির্যাতিত নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ না দিয়ে সদস্য করা হয়েছে। জায়গা হয়নি হরিণাকুন্ডু থানা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হকের। পৌর ছাত্রদলের বর্তমান যুগ্ম আহবায়ক ও সভাপতির ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত বাপ্পিকে জেলা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক করা হয়েছে। অনেক ত্যাগী নেতা ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির কমিটিতে স্থান না পেলেও সভাপতি এম.এ মজিদের শশুর ও কালীগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি আতিয়ার রহমানকে সহ-সভাপতি পদ দিতে ভূল করেননি।

এদিকে জেলা বিএনপির কাউন্সিলে থানা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট কামাল আজাদ পান্নু ও পৌর বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ বিশ্বাস পদত্যাগ করে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে থানা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট কামাল আজাদ পান্নু জেলা বিএনপির সভাপতি ও সম্পাদকের পচ্ছন্দের ব্যক্তি হওয়ায় তাকে থানা বিএনপির সভাপতির পদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। অথচ আব্দুল মজিদ বিশ্বাসকে পৌর বিএনপির সভাপতির পদ ফেরত দেওয়া হয়নি।

সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আ’লীগের মহিলা এমপির জামাই সাজেদুর রহমান পপ্পুকে অর্থের বিনিময়ে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়েছে। পপ্পু পরোকীয়ার মাধ্যমে ঘরে স্ত্রী সন্তান থাকার পরও অন্যের স্ত্রী ভাগিয়ে বিয়ে করেন। জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতাকারী আসিফ ইকবাল মাখন ও জাহাজাহান আলীকে সাংগঠনিকের বাকী দুইটি পদ দেওয়া হয়নি। জেলা বিএনপির ১নং সিনিয়র সভাপতির মতো ভাইটাল পদে অসুস্থ আক্তারুজ্জামানকে বসানো হয়েছে। তিনি সদ্য পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় নির্দেশ অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট করেন। তার বিরুদ্ধে আর্থিক লেনদেনেরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়াও কখনো বিএনপির কোন পদ না পেয়েও টাকার বিনিময়ে মুর্শিদা জামান, আশরাফুল ইসলাম স্বপন ও সাবেক এমপি শহদিুজ্জামান বেল্টুর বাসার কেয়ার-টেকার রেজাউল ইসলাম নুনু জেলা বিএনপির উপদেষ্টা সদস্য হয়েছেন।

বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডুকে রোববার বিকেলে মুঠোফোনে কমিটির ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেন নি।

এ ব্যাপারে জানতে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলামকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

বিএনপির সাবেক সভাপতি বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি দলের কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত দেওয়া আছে পৌর, উপজেলা ও জেলা বিএনপির কমিটিতে এক নেতা এক পদ পাবেন। একজন নেতা একের অধীক পদ পাবেন না। যদি কোন নেতা একের অধীক পদে থাকেন তবে সেটা অবৈধ হিসাবে বিবেচিত হবে। নতুন কমিটিতে এমন অনেক নেতা একাধিক পদে রয়েছেন যা অবৈধ।

বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এ্যাডভোকেট এম এ মজিদ সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, টপ ফাইভ ( সভাপতি, ১ নং সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, ১ নং সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক) পদে দলের এমন নির্দেশনা আছে। অন্যান্য পদে নেই। দলে অপ্রাপ্ত বয়সীদের পদ দেওয়া নিয়ে তিনি বলেন ১৮ বছর হলেও যে কেউ বিএনপির সদস্য হতে পারবে। তিনি বলেন যারা জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন তারা বিএনপির ভালো চান না।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here