ঢাকা:

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা তালাকের ঘটনা। গত ১০ বছরে শুধু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকাতেই প্রায় ৯৩ হাজার ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়েছে। বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে, সে হিসেবে প্রতি ৩৮ মিনিটে একটি দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারীরা।

১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, তালাকের নোটিস সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। প্রথমে সেখানে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে তালাকের আবেদন স্বামী এবং স্ত্রী সিটি করপোরেশনের কোন অঞ্চলে বাস করেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়। পরে আবেদনকারী ও বিবাদী উভয়পক্ষকেই আপসের নোটিস পাঠান সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট)। দুই পক্ষের মধ্যে আপস না হলে সিটি করপোরেশনের আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। আইন অনুযায়ী, আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ আপস বা প্রত্যাহার আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়।

ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৭টি বিবাহ বিচ্ছেদ : ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করেছেন পাঁচ হাজার ৪৮৭ জন। এর মধ্যে উত্তরে আবেদন করেছেন দুই হাজার ৮২৫টি, দক্ষিণে দুই হাজার ৬৬২টি। সে হিসেবে দুই সিটি করপোরেশনে দিনে ৩৭টি তালাকের আবেদন পড়েছে। যা ঘণ্টায় এক দশমিক পাঁচেরও বেশি। সে হিসেবে প্রতি ৩৮ মিনিটে একটি দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটছে।

দশ বছরে ৯৩ হাজার ডিভোর্সের আবেদন : দুই সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে ৫,৪৮৭টি তালাকের আবেদন জমা পড়ে।

এর আগে ২০২০ সালে করোনা মহামারী পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকার দুই সিটিতে ১২ হাজার ৫১৩টি ডিভোর্সের আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৮১টি আবেদন করেছেন নারীরা। বাকি ৪ হাজার ৩২টি বিচ্ছেদ চেয়েছেন পুরুষ। সে হিসেবে নারীদের তরফে ডিভোর্স বেশি দেওয়া হয়েছে ৭০ শতাংশ।

এছাড়া ২০১৯ সালে প্রায় ১২,২৯২টি, ২০১৮ সালে ১০,২০০টি, ২০১৭ সালে ১০,২৯১টি, ২০১৬ সালে ৯,৭৪৪টি, ২০১৫ সালে ৮,৮৩৮টি, ২০১৪ সালে ৯,০৪৫টি, ২০১৩ সালে ৭,৭০৮টি এবং ২০১২ সালে ৭,৪০২টি ডিভোর্সের আবেদন জমা হয়েছিল দুই সিটি করপোরেশনে। সব মিলিয়ে গত দশ বছরে প্রায় ৯৩ হাজার ৫২০টি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করা হয়েছে শুধু মাত্র ঢাকা শহরেই।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমঝোতায় যান না দম্পতিরা: ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৩ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল বাকী বলেন, স্বামী বা স্ত্রী যে পক্ষই আবেদন করুক, আগে উভয়পক্ষকেই সমঝোতার নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সমঝোতায় যান না। উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকেন। দ্বিতীয়বার নোটিস দিলেও তারা উপস্থিত হন না। আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে সমঝোতা না হলে তা কার্যকর হয়ে যায়।

যেসব কারণে বাড়ছে তালাক: দুই সিটি করপোরেশনে জমা হওয়া আবেদনগুলো থেকে জানা গেছে, তালাক বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া। নারীরা তালাকের আবেদনে যেসব কারণ বেশি উল্লেখ করা হয় সেগুলো হলো- স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, পরনারীর সঙ্গে সম্পর্ক, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে আর ফিরে না আসা, মাদকাসক্তি, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি, পুরুষত্বহীনতা, আর্থিক অসচ্ছলতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। আর পুরুষদের দর্শানো কারণগুলোর মধ্যে- স্বামীর অবাধ্য হওয়া, ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়া, পরকীয়া বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৭০ শতাংশ ডিভোর্সই দিচ্ছেন নারীরা: দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন বাড়ছে। উত্তর ও দক্ষিণে তালাকের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশই স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধনমুক্ত থাকার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান, বনানী, মহাখালীর মতো অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। আবার দক্ষিণ সিটিতে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার, ওয়ারী এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দিচ্ছেন।

নেপথ্যে নৈতিকতার পতন, মূল্যবোধের অবক্ষয়: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নৈতিকতার পতন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপ, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, একে অপরের মূল্যায়ন না করাসহ নানা কারণে মানুষ বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ঝুঁকছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ এহসান হাবীব বলেন, করোনাকালে বিবাহ বিচ্ছেদ আরও বেশি বেড়ে গেছে। কারণ এ সময়ে মানুষ এক রকম গৃহবন্দি জীবনযাপন করেছে। আর এতে দম্পতিরা একে অপরকে সব সময় পাশে পেয়েছেন, সময় দিয়েছেন। সঙ্গীরা যখন অনেক বেশি এভেইল্যাবেল হয়ে যায় তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র্র বিষয় নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এছাড়া এখন মানুষের আয় নেই। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যারা রয়েছেন তারা এতদিন একভাবে চলে এলেও হুট করে এ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে দেখা দিচ্ছে একটি বড় ব্যবধান। এই ব্যবধানটা মেনে নিতে না পারার কারণেও বিচ্ছেদ বাড়ছে।

ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের পারিবারিক বন্ধনটা অনেক বেশি দৃঢ় হলেও শহুরে পরিবারগুলোয় তা নয়। গ্রামে সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি দায়বদ্ধ। সেখানে সবসময় আত্মীয়স্বজন যাওয়া-আসার মধ্যে থাকে। ফলে পারিবারিক কলহের সুযোগটাও কম। যা শহুরে জীবনে দেখা যায় না। শহুরে মানুষের আলাদা একটা জগৎ থাকে। সেখানে সবাই নিজের মতো করে থাকতে পছন্দ করে। সেখান থেকেও বাড়ছে বিচ্ছেদের ঘটনা।

নারীরাই কেন বিচ্ছেদের দিকে বেশি ঝুঁকছেন?

নারীরাই কেন বিচ্ছেদের দিকে বেশি ঝুঁকছেন এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়ে গেছে। পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদও করছে। স্বামী অথবা পরিবার কর্তৃক শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা কথা বলছে। নারীর ক্ষমতায়নের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়েও উপার্জনক্ষম নারী বাড়ছে। এসব কারণে নারীরা তালাকের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন।

স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদে বিপাকে শিশুরা : সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়দায়িত্ব বাবার ওপরই থাকে। সেজন্য কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করলে নাবালক সন্তানের ভরণ পোষণ দিতে হয় বাবাকেই। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা কলহের জেরে আলাদা বসবাস বা বিচ্ছেদের পর অনেক বাবাই সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না। দিতে চান না ভরণ-পোষণ। নিরূপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্ত হন সন্তানের মা।

আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মা সন্তানদের বাবার ভরসায় ছেড়ে দিয়ে চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে বাবার সান্নিধ্যে সন্তান বেড়ে উঠলেও বঞ্চিত হয় মায়ের স্নেহ থেকে। এ ছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় সন্তানকে দেখাশোনার জন্য বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে, কিন্তু সৎ মা তাকে মায়ের আদর দিতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, সন্তানের দায়িত্ব নিতে না পেরে তাকে সেইফ হাউজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আমানুল্লাহ ফেরদৌস বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানদের ওপর। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না যে কার কাছে থাকবে। ফলে তারা বাবার কাছে থাকবে না মায়ের কাছে থাকবে সেটা কোর্ট ছাড়া নির্ণয় করা কঠিন হয়ে যায়। এছাড়া বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলে সন্তানের ভেতরে একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ জেগে উঠে। সে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here