শাহরিয়ার আলম সোহাগঃ

২০১২ সালের শেষের দিকে এই পেশায় আমার পথচলা শুরু। বিশেষ করে বাবা সাংবাদিক হওয়ায় এই পেশায় আশা আমার। দেখতাম বাবা এক প্রতিবন্ধীর হুইল চেয়ারের জন্য নিউজ করলে বেশ ভালো সাড়া পেত। কারো দুর্নীতির নিউজ করলে আবার প্রশাসন বেশ তৎপর হয়ে যেত। তখন আমি ভাবলাম, এই পেশায় থাকলে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যাবে। আবার সমাজের ত্রুটি, বিচ্যুতিগুলোর মুখোশও খুলে দেওয়া যাবে।

২০১২ সালে শুরু হলো এই পেশায় পথচলা। পড়ালেখার সুবাদে ঢাকায় থাকা। সেখান থেকেই ঢাকার ফার্মগেটে একটি নিউজ পোর্টালের পোস্টার দেখতো পাই। নাম ছিল শিরোনাম টুয়েন্টিফোর ডটকম। সিভি পাঠালাম। কিছুদিন পর আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড দিল। ঢাকায় বসুন্ধরা শপিং মলের বিপরীতে অফিসে গেলাম। অফিসের স্টাফরা জানতো যে, আমি ঝিনাইদহ থাকি। আসলে না, আমি ঢাকায় থেকে ঝিনাইদহের নিউজ পাঠাতাম। বাবার মেইল থেকে নিউজ নিয়ে নিজের নামে পাঠাতাম। নিউজ ছাপতো, ফেসবুকে শেয়ার দিতাম বেশ ভালোই লাগতো।

কিছুদিন হারিয়ে গেল প্রথম আইডি কার্ড পাওয়া শিরোনাম টুয়েন্টিফোর ডটকম। এরপর সন্ধান পেলাম পরিবর্তন ডটকম নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে। সেখানে সিভি দেওয়ার পর নিউজ পাঠাতে থাকলাম। তখনো আমি ঢাকায় থাকি। এই অফিসও জানতো আমি ঝিনাইদহে থাকি। নিয়োগ পাওয়ার আগে এই অনলাইনে ঝিনাইদহ থেকে দুইজন নিউজ পাঠাতাম। একজন মাঠ কাঁপানো সাংবাদিক তখনকার সময়ে সময় টেলিভিশনের ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি শাহনেওয়াজ খান সুমন আর অভিজ্ঞহীন এই আমি। যেদিন ক্লাস থাকতো না নিউজ আগে দেওয়ার জন্য সব সময় কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতাম। প্রতিযোগিতা শুরু হলো আমার আর সুমন ভাইয়ের মধ্যে। সে ঝিনাইদহ থেকে আর আমি ঢাকা থেকে। এরপর একদিন সুমন ভাইকে ফোন দিলাম। ভাইকে বললাম আপনি তো সময় টেলিভিশন সহ বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাথে আছেন। ছোট ভাইয়ের জন্য পরিবর্তন ডটকমটা ছেড়ে দেন। সুমন ভাই আমাকে উত্তরে বললেন, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে নাও। এরপর আর কখনো কাউকে অনুরোধ করিনি। খুব রাগ হয়েছিল সে সময়। কিন্তু এর একটা মজাও আছে। দুই জনের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রায় ১ বছর পর শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন ডটকম আমাকে ফাইনাল করলো ঝিনাইদহ প্রতিনিধি হিসেবে। (এই লেখাটি পরিবর্তন ডটকমের কেউ পড়লে, আমাকে ক্ষমা করবেন।)

পরিবর্তন ডটকমে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিন পর আমি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি। পরিবর্তনেই শুধু কাজ করি। এদিকে ঢাকা ছেড়ে দিয়ে কালীগঞ্জ আসায় পরিবার থেকেও অনেক বকাবকি শুনতে থাকি। কিন্তু আমার ভেতরে শুধু একটা কথা বেজে ওঠে- নিজের যোগ্যতা দিয়ে প্রমাণ করো। আমাকে এই সাংবাদিক পেশায় অনেক দূর যেতে হবে। একদিকে পরিবারের চাপ অন্যদিকে আমি অনড় এই পেশাকে আগলে ধরতে।

পরিবর্তন ডটকমে প্রথম ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার এক প্রতিবন্ধী স্কুল ছাত্রকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করলাম। সেই রাতেই চট্টগ্রাম থেকে একজন দানশীল ব্যক্তি ফোন দিয়ে বলেন আমি ওই ছাত্রকে একটি হুইল চেয়ার দিব। এরপর অনেক আনন্দিত হলাম আমি। বাবাকে বললাম বিষয়টা। সেও আমাকে বললো এমন নিউজ করতে হবে।

বলে রাখি তখনও আমার বাবা আমাকে সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এরপর বাংলা টিভি আসলো । সিভি পাঠালাম। তারা ইন্টারভিউ নিলো। ঝিনাইদহের ৪ জন ইন্টারভিউ দিলাম। আমাকে ফাইনাল করলো বাংলা টিভি। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ৩/৪ মাস পর বাংলা টিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এর মাঝে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় জড়িত নিরবাস ঝিনাইদহে থাকতো এই প্রতিবেদন তৈরি করে পরিবর্তন ডটকমের সেরা প্রতিনিধি হলাম। এর পরের মাসে পরিবর্তন ডটকমের প্রতিনিধি সম্মেলনে গিয়ে সারা দেশের ১৯ প্রতিনিধির মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। যতটুকু প্রতিবেদন লিখতে শিখেছি, বেশিরভাগই পরিবর্তন ডটকমের মাধ্যমে। এই হাউজটি আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে।

কালীগঞ্জের কোটচাঁদপুর সড়কে একটি অফিসে আমি বসতাম। এরপর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের দিকে দৈনিক যুগান্তরের ঝিনাইদহ প্রতিনিধি মিজানুর রহমান চাচা আসলেন ওই অফিসে। তিনি বললেন, কালীগঞ্জে একজন প্রতিনিধি নেওয়া হবে। এরপর তিনি আমাকে সহযোগিতা করে দৈনিক যুগান্তরে লেখার অনুমতি নিয়ে দেন। এরপর থেকেই দৈনিক যুগান্তর ও পরিবর্তন নিয়েই আছি। এছাড়াও সবুজদেশ নিউজের বার্তা প্রধান হিসেবে কাজ করছি।

দৈনিক যুগান্তরে কাজ করার পর আমার বাবা আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করলো যে কিছুটা লেখালেখি করতে পারে হয়তো। একদিন বাবা বললেন, সত্য বিষয়ে নিউজ করতে হবে। রিস্ক না নিলে ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না। সত্য বিষয়ে নিউজ করবা, তোমার পিছনে আমি আছি। আর আমার রুখে কে?

এতক্ষণ নিজেকে জাহির করলাম। এবার একটু মুল কথায় আসি। সত্যি বলতে কি আমি এখন নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা পাই। এর পিছনে অনেক কারণ আছে।

৫ম শ্রেণি পাশরা যখন সাংবাদিক। এদিক ওদিক দাঁপিয়ে বেড়ায়। তখন নিজের কাছেই লজ্জা করে। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি আমিও সাংবাদিক? আর হ্যা, তিনি সাংবাদিক হয়েছেন আমাদের মতো কিছু সাংবাদিক বানানোর কারিগরদের কারণে। কারণ এসব সাংবাদিক না বানালে তো নিজেদের নষ্টামি করা যাবে না। নিউজ লেখা তো দূরের কথা মেইল দিয়ে পাঠানোর সময় অনেকের হয় না। এমন সাংবাদিক মাঠে-ময়দানে বেশিই দেখা যায়। আবার কোন কিছুই নেই। পকেটে থাকে নাম সর্বস্ব হাউজের আইডি কার্ড। তিনি কিন্তু আবার মাঠ কাঁপানো সাংবাদিক। আসলে এদের জন্য প্রকৃত সাংবাদিকরা কোনঠাসা। কারো বিরুদ্ধে নিউজ করলে সঙ্গে সঙ্গে তেল মেরে পকেট ভারি করতে ব্যস্ত হয়ে যান তারা।

উপরের আমার জাহির করা লেখা পড়েছেন। আসলে আমি সাংবাদিক হতে চেয়েছি, কিন্তু আজকাল যেসব সাংবাদিক চোখে পড়ে তাতে আমার সাংবাদিক বলতে লজ্জাই করে। কিছু মিডিয়া হাউজ ও আমাদের মতো সাংবাদিক বানানোর কারিগরদের কারণে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

আমার মতে, একজন সাংবাদিক সমাজের জন্য অনেক অবদান রাখতে পারে। আবার একজন সাংবাদিক সমাজের জন্য অনেক ক্ষতিকর হতে পারে।

একজন সাংবাদিক সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন। ঠিক তেমনই সামাজিক ও মানবিক অনেক কাজ করতে পারেন। আবার সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো তুলে ধরতে পারেন। আমি মনে করি, এটি একটি মহান পেশা। কিন্তু এই মহান পেশাকে যারা কলঙ্কিত করছেন শুধু তাদের প্রতি রইলো ঘৃণা আর ধিক্কার।

লেখকঃ গণমাধ্যমকর্মী  

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here