কুষ্টিয়াঃ

নির্মানকালে গোড়ায় গলদ রেখে কাজ সম্পন্ন করায় গত বছরের ন্যায় একই স্থানে আবারও ধ্বসে গেছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ী রক্ষা বাঁধ। বুধবার সকালে শুরু হওয়া ধ্বসে কুমারখালী উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের পূর্বাংশে বাধের ৩০ মিটার এলাকা জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, বাধ নির্মানের সময় অনিয়ম থাকায় গতবছর যে কারণে ধ্বসেছিলে এবারও কারণ একই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি তাৎক্ষনিক জরুরী ভিত্তিতে সংরক্ষিত ব্লক ফেলে ধ্বসে যাওয়া অংশের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রনে।

কয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম স্বপনের অভিযোগ, স্থানীয় জনগণের ক্ষতি সাধন, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, নির্ধারিত পরিকল্পনা ও নঁকসা বহির্ভুত, প্রয়োজনীয় সামগ্রী অব্যবহৃত রাখা, ব্যয়িত অর্থের অপচয়, অনিয়ম ও দূনীতির মধ্যদিয়ে অসম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পন্ন দেখিয়ে হস্তান্তর করে প্রভাবশালী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন ‘ডিজেল প্লান্ট’ এবং সহযোগী ‘ওয়েষ্টার্ন ইঞ্জিয়ারিং কোং’ এর দৌরাত্ম এবং কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ন ও যোগসাজসে প্রায় ২শ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পাশ^বর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পটির টেকসই স্থায়ীত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ। বিষয়টি শুধু আমি নই, সয়ং পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ও স্বীকার করেন। এসব কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছিলো বলে জানালেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।

উল্লেখ্য “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পটি ব্যাপক অনিয়ম, দূর্ণীতি, নির্ধারিত পরিকল্পনাসহ নঁকসা লংঘন, অর্থ অপচয় এবং বরাদ্দকৃত টাকা প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় না করে অব্যয়িত রাখায় প্রায় ২’শ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্পটির সাস্ট্যানেবিলিটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন ডিজেল প্লান্ট লি: এর ২’শ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মহাপরিচালক দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ২২জুলাই মহাপরিচালক বাপাউবো’র সভাপতিত্বে প্রধান প্রকৌশলী, প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত এবং গত ২৬ জুলাই ২০১৮ পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মতে, পরিকল্পনা শাখা-৩ হতে জরুরী ভিত্তিতে ইস্যুকৃত এবং সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক দপ্তরে প্রেরিত এক পত্র মারফত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে- “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পাশ^বর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক মনিরুজ্জামানকে।

৪২.০০.০০০০.০৪১.০৬.০১১.১৮-২২৯ নং স্মারকের ঐ পত্রে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আরডিএপিভুক্ত পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রকল্প সমুহের ২০জুন,২০১৮ পর্যন্ত অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় গৃহীত কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত অবগতি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশনা প্রেরণ করা হলো। ওই সভায় নির্দেশনা তালিকার ৬নং ক্রমিকে আলোচ্য সূচীতে বলা হয়েছে- ‘কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ’ শীর্ষক প্রকল্পের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রকৌশলী সভাকে অবহিত করেন যে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইউচখ কর্তৃক সম্পাদিত কাজের পরিমান সন্তোষজনক নয়। কাজের গতি বাড়ানোর জন্য ইউচখ এর সাথে বারংবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে।

বিস্তারিত আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপূরন হিসেবে জরিমানা করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে এই জরিমানা আদায়ে যথাশীঘ্র সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের দায়িত্ব অর্পিত হয় প্রকল্প পরিচালকের উপর।

উল্লেখিত সিদ্ধান্তের সত্যতা নিশ্চিত করে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত পাশ কাটানোর কোন সুযোগ নেই। ঐ প্রকল্পের কাজের গতি দেখে আমরা বারংবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পত্র প্রেরণ করেছিলাম। তারা সে সময়ে গুরুত্ব দেননি বলেই এমনটি হয়েছে। তাছাড়া প্রকল্পের মূল ঠিকাদার যেহেতু সেনাবাহিনীর অংগ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ডিজেল প্লান্ট লি: ইউচখ সেক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকলেও কাংখিত লক্ষ্যে পৌছুতে পারিনি। সেকারণে কার্যাদেশ চুক্তির শর্ত ভঙ্গের দায়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পেনাল্টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব আমি পালন করেছি মাত্র। শর্তানুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মাণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক বছর পর্যন্ত রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকায় গত বছরের ধ্বসে যাওয়া ঠেকাতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে ধ্বসে যাওয়ার কারণে নির্মান ত্রুটির প্রশ্ন উঠে। সেকারণে তাদের জমাকৃত মোট প্রাক্কলন দরের ১০% হিসেবে প্রায় ২কোটি টাকা জরিমানা কর্তন করা হয়।

এই প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, একাজের মূল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইউচখ হলেও সহযোগী (সাব কন্টাক্ট্রর) ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী লি: মূলত: ফিল্ডের দায়িত্ব পালন করেন। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী লি: দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। তারা রীতিমতো ডেলিগেট সিস্টেমে তাদের ব্যবসা করেন। দেশের বড় বড় নির্মাণ প্রকল্প যাতে ইউচখ বা নৌবাহিনী বা বিমান বাহিনীর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান পায় সে ব্যাপারেও তাদের রয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ। এসব ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঠুটো জগন্নাতের ভুমিকা পালন করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। কাজ বুঝে নেয়ার দায়িত্ব থাকলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যেভাবে চালান সেটাই আমাদের মেনে নেয়া ছাড়া কোন বিকল্প নাই। অথচ বাস্তবতা হলো- প্রকল্পের বাস্তবায়নে কোন বিচ্যুতি দেখা দিলে সর্বমুখী আক্রোশের শিকার হই আমরা। এসব আমাদের নিরবেই হজম করতে হয়।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী পিযুষ কৃষ্ণ কুন্ডু বলেন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া ডিভিশনের তত্ত্বাবধায়নে “কুষ্টিয়া জেলায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় পদ্মা নদীর ডান তীর সংরক্ষণ” প্রকল্পের সুলতানপুর অংশে ২হাজার ৭২০ মিটার এবং শিলাইদহ অংশে ১হাজার মিটার সংরক্ষন বাধ নির্মাণ সম্পন্ন হয়। গত বরছ যে স্থানে ধ্বসেছিলো এবারও ঠিক একই স্থানে এই ধ্বসের কারন হলো- বাঁধ নির্মানের সময় নদীর তলদেশের ডাম্পিংএ ধ্বসে গেলে তখন উপর থেকেও ধ্বসে যায়। একই ঘটনা যাতে বারংবার না হয় সেজন্য আগামী শুষ্ক মৌসুমে ডিজাইন বিভাগের মাধ্যমে পরামর্শ নেয়া হবে। কিভাবে এর স্থায়ী সমাধান করা যায়। তবে যতটুকু ধ্বসে গেছে সেখানে ইতোমধ্যেই সংরক্ষিত ব্লক ফেলে পরিস্থিতি এখন পুরোটাই নিয়ন্ত্রনে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here