রংপুরঃ

ক্রিকেটের প্রতি তার টান সেই ছোটবেলা থেকে। যে বয়সে বন্ধুদের ব্যাগ ভারি থাকতো বই-খাতায়, সে বয়সে ব্যাগে ক্রিকেট বল নিয়ে ঘুরতেন আকবর। যেন দুনিয়া বোঝার আগেই ক্রিকেট ‍বুঝে ফেলেছিলেন রংপুরে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার।

ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। যদিও বাবা-মা ক্রিকেট খেলতে দিতে চাইতেন না। তবুও ঝোঁক থামেনি, বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে ক্রিকেট খেলে যেতেন আকবর আলী। পরবর্তী সময়ে তারাই ছেলের শক্তিতে পরিণত হন। আকবরকেও আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ইতিহাস রচনার পথে এক পা করে এগিয়ে গেছেন।

ক্রিকেটের জন্য ঘর পালানো মফস্বল শহরের ছেলেটির হাত ধরে বাংলাদেশ পেল বিশ্বজয়ের স্বাদ। যুবাদের ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব জয়ের গল্প লেখা হলো আকবরের নেতৃত্বেই।

প্রথমবারের মতো আইসিসি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শিরোপা অর্জনের নায়ক হলেন আকবর। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২২ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলল বাংলাদেশ।

ক্রিকেটের প্রতি তার টান সেই ছোটবেলা থেকে। যে বয়সে বন্ধুদের ব্যাগ ভারি থাকতো বই-খাতায়, সে বয়সে ব্যাগে ক্রিকেট বল নিয়ে ঘুরতেন আকবর। যেন দুনিয়া বোঝার আগেই ক্রিকেট ‍বুঝে ফেলেছিলেন রংপুরে জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার।

ক্রিকেটে বসবাস করবেন বলে ছোটবেলাতেই মন স্থির করায় রংপুরের একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান আকবর। তার ক্রিকেটের পথটা সুগম করে দেন রংপুরের কোচ অঞ্জন সরকার। সেই পথ ধরে হেঁটে ২০১২ সালে বিকেএসপিতে সুযোগ মিলে যায় তার। এরপর শুধু ক্রিকেট আর তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছে বাংলাদেশ যুবারা। যেখানে বড় অক্ষরে লেখা হচ্ছে আকবরের নাম। তার ব্যাটেই যে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ যুব দল। শিরোপার লড়াইয়ের ম্যাচে ভারতের লেগ স্পিনার রবি বিষ্ণুনয়ের আঘাতে বাংলাদেশের ইনিংস যখন ওলট-পালট, তখন আলোকবর্তিকা হাতে উইকেটে ছুটে যান আকবর।

উইকেটে দেখা মেলে এক যোগ্য নেতার। কতোটা ঠাণ্ডা মেজাজে নেতার দায়িত্ব পালন করতে হয়, সেটা ব্যাট হাতে প্রমাণ করে দেখান তিনি। প্রথম সারির কোনো ব্যাটসম্যান না থাকলেও রকিবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন ৪৩ রানের হার না মানা ইনিংস খেলা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।  

বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা পেয়ে পুরো দেশ এখন উৎসবের আমেজে। সেই আমেজটা সবার চেয়ে অনেক বেশি করে ছুঁয়ে যাচ্ছে আকবরের বাবা মোহাম্মদ মোস্তফাকে। ছেলের এমন কৃতিত্বে আজ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। তার চোখে এখন আনন্দের অশ্রু। আনন্দের পরিমাণ এমন যে, ছেলেকে নিয়ে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।

মা শাহিদা বেগমও ঠিকভাবে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছেন না। শুধু বললেন, ‘এটা সমগ্র দেশবাসীর জয়। অনেক কষ্ট করে আকবর এতদূর এসেছে। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন।’

ঘরের ছেলের এমন সাফল্যে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে রংপুর। সোমবার সকাল থেকেই নগরের জুম্মাপাড়ায় চলছে আনন্দ মিছিল ও রঙের খেলা। খণ্ড খণ্ড মিছিল বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করতে দেখা গেছে। অনেকেই আকবরের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সবখানে যখন আনন্দের জোয়ার, আকবরের মনের কোথাও যেন বিষন্ন সুর বেজে যাচ্ছে। উদযাপন করতে থাকা আকবরকে দেখে সেটা অবশ্য সেটা বোঝা যাবে না। কিন্তু তার ভেতরটা হয়তো ডুকরে কাঁদছে। যে বোনকে সুস্থ রেখে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ খেলতে গেছেন আকবর, সেই বোন এখন না ফেরার দেশে।

বিশ্বজয়ী আকবর শিরোপা নিয়ে বীরের বেশে দেশে ফিরবেন, সেটা আর দেখা হবে না বোন খাদিজা খাতুনের। জমজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে গত ২২ জানুয়ারি মারা যান বাকশক্তিহীন খাদিজা। এমন খবরেও আকবর মুষড়ে যাননি, বোনকে হারানোর শোক থেকেই শক্তি সঞ্চয় করে শিরোপার পথে দলকে নিয়ে গেছেন তিনি।

আকবরদের চার ভাইয়ের একমাত্র বড় বোন ছিলেন খাদিজা। ভাইয়ের ক্রিকেট নিয়ে তার আগ্রহের শেষ ছিল না। আকবর ক্রিকেট খেলতে গেলেই জায়নামাজে বসে যেতেন খাদিজা, সব ধরনের সমর্থন দিতেন ক্রিকেট খেলার জন্য। দোয়া করতেন প্রিয় ছোট ভাইয়ের ভালো খেলা আর সুস্থতার জন্য। আকবর ঠিকই ভালো খেলে বিশ্বজয় করলেন, কিন্তু সেটা আর দেখা হলো না খাদিজার।

১৮ জানুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আকবরদের ম্যাচটি দেখেছেন খাদিজা। পরের ম্যাচের অপেক্ষায় থাকা খাদিজা ২২ জানুয়ারি নিজের লড়াই জিততে পারেননি। খবরটি প্রথমে জানানো হয়নি আকবরকে। যদিও খবরটি জেনে যান আকবর।

বৃষ্টিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর আকবর ফোন দেন তার মেঝো ভাইকে। জানতে চান, তাকে কেন খবরটি জানানো হলো না। ওই ফোনকলের সময় কেমন অবস্থা হয়েছিল, সেটা জানাতে পারছিলেন না একমাত্র মেয়েকে হারানো মোহাম্মদ মোস্তফা।

কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কী বলব এটা নিয়ে আর! এমন খুশির ব্যাপারটিও সেভাবে পালন করার ভাগ্য নেই। আমার একমাত্র মেয়ের খবর তো আপনারা জানেন। এটা অনেক বড় ধাক্কা আমাদের জন্য। আকবর যে এই শোক কাটিয়ে খেলতে পেরেছে, সে কারণে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।’

চার ভাইয়ের মধ্যে আকবর সবার ছোট। তার বড় ভাই মুরাদ হোসেনও ছিলেন পেশাদার ক্রিকেটার। ২০১৭ সালে ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়া মুরাদ খেলেছেন ঢাকা লিগ ও খুলনা প্রিমিয়ার লিগে। তাকে দেখেই মূলত ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক বাড়ে আকবরের।

ছোট ভাইয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত মুরাদ বলেন, ‘এটা আসলে ভাষায় বলার মতো না। আকবর যেটা অর্জন করেছে, এটা পুরো বাংলাদেশের অর্জন। ওকে বিকেএসপিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। আমিও ক্রিকেট খেলতাম। ঢাকা লিগে, খুলনা প্রিমিয়ার লিগে ইলিয়াস সানি, শুভদের সঙ্গে খেলেছি। আমি যেটা পারিনি, আমার ভাই সেটা করেছে।’

একমাত্র বোন খাদিজার কথা মনে করাতেই মুরাদের কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে। বড় ভাই মুরাদ বলেন, ‘আমাদের চার ভাইয়ের একটা বোন ছিল। বোনটা আমার কথা বলতে পারতো না, ও অনেক আদরের ছিল। এমন খবর আকবরকে আমরা জানাতে পারিনি। জেনে ও নিজেই ফোন দিয়েছিল। বলছিল কেন জানাইনি।’

বোনের মৃত্যুর ১৯ দিনের মাথায় দেশকে শিরোপার আনন্দে ভাসিয়েছেন আকবর। কীভাবে শোক কাটিয়ে দুঃসময়েও দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যেতে হয়, আকবর সেটার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যে দৃষ্টান্ত শুধু ক্রিকেটেই নয়, জীবনের পথচলাতেও অনুপ্রেরণা হতে পারে ভবিষ্যতের আরও অনেক আকবরদের জন্য। 

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here