ফারুক নোমানীঃ

বৃক্ষ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। স্রষ্টার অনন্য সৃষ্টি। পৃথিবীকে শীতল করতে, মানব সমাজকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সুন্দর রাখতে বৃক্ষের অবদান অনেক বেশি। বৃক্ষ পরিবেশকে শান্তস্নিগ্ধ রাখে। বাতাসকে করে পরিশীলিত। কার্বন ডাই-অক্রাইড শুষে নিয়ে বাতাসকে করে বিষমুক্ত। আবার এই বৃক্ষের কারণেই আমরা পাই আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজনীয় অক্রিজেন।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত: একটি পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষ বছরে যে পরিমাণ অক্রিজেন সরবরাহ করে তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্রিজেনের চাহিদা মেটাতে পারে। বৃক্ষ মাটির ক্ষয় রোধ করে। বন্যা প্রতিরোধ করে। ঝড়-তুফানকে বাধা দিয়ে জীবন ও সম্পদের হেফাজত করে। তাই তো ইসলাম উৎসাহ দিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে অধিকহারে বৃক্ষরোপণ করতে। নিষেধ করেছে তা অহেতুক কর্তন করতে, এমনকি প্রয়োজনহীন তার একটি পাতা ছিঁড়তেও। বৃক্ষ যেমন সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করে, তেমনি তা প্রাকৃতিক অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীকও বটে, আবার নানা রোগের প্রতিষেধকও। সর্বোপরি বৃক্ষরোপণকে ইসলাম অন্যতম ইবাদত সদকায়ে জারিয়াহ বা চলমান দান বলে আখ্যা দিয়েছে। সাথে সাথে বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যার জোরালো তাগিদও করেছে। ফলে সাওয়াবের নিয়তে কেউ বৃক্ষরোপণ করলে যতদিন বৃক্ষটি থেকে উপকৃত হওয়া যাবে ততদিন রোপণকারী সাওয়াব পেতে থাকবেন। এমনকি মৃত্যুর পরও এ সাওয়াবের ধারা বন্ধ হবে না। এজন্যই তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে অসংখ্য বৃক্ষ রোপণ করেছেন। সাহাবীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। আদেশ করেছেন তার নিয়মিত পরিচর্যার। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘য়ালা বিভিন্ন জায়গায় বৃক্ষের কথা আলোচনা করেছেন।

তবে ইসলামে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব বুঝতে এই হাদীসটিই যথেষ্ট। প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যদি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্তেও তোমাদের কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে, তাহলে সে যেন তা রোপণ করে দেয়। (আহমাদ ১২৯০২)

প্রিয় পাঠক! দেখুন ইসলামের সৃষ্টিশীলতার কি অপূর্ব দৃষ্টান্ত। পৃথিবী ধ্বংসের ঠিক আগ মুহূর্তেও যদি কারো হাতে একটি চারাগাছ থাকে ইসলাম আদেশ করেছে তা রোপণ করে দিতে। অনুধাবন করুন শাশ্বত এই ধর্মে বৃক্ষরোপণের কী পরিমাণ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে!

বৃক্ষরোপণের ফযিলত
একটি বৃক্ষ যেমন সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ গড়তে সহায়তা করে, তেমনি আবার রোপণকারীর আমলনামায় সংযুক্ত করে মহাপুণ্যের এক চলমান ধারা। যে ধারা তার মৃত্যুর পরও থাকে বহমান। কবরেও পৌঁছতে থাকে সে পুণ্যধারা। যতদিন বৃক্ষটি বেঁচে থাকে, এ ধারা চলমান থাকে ততদিন পর্যন্ত। তাই তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতেগড়া সাহাবীরা পুণ্যের একান্ত প্রত্যাশায় বৃক্ষরোপণে আদর্শ স্থাপন করেছেন। প্রখ্যাত সাহাবী আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত : তিনি দামেশকে গাছ লাগাচ্ছিলেন, এমন সময় তার পাশ দিয়ে এক ব্যক্তি যাচ্ছিলো। তাঁকে গাছ লাগাতে দেখে লোকটি বলে উঠলো- আপনি আল্লাহর রাসূলের সাহাবী হয়ে গাছ লাগাচ্ছেন? তখন আবু দারদা রা. তাকে বললেন, একটু শুনে যাও! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: যখন কেউ গাছ লাগায় আর তা থেকে কোন মানুষ বা প্রাণী খায় এটা তার জন্য সাদাকাহ হিসেবে গণ্য হবে। (আহমাদ ২৭৫০৬)।

আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- কোন মুসলিম যদি গাছ লাগায়, তা থেকে কোন মানুষ বা পশু যদি কিছু খায়, তবে তা তার জন্য সাদাকাহ (দান) হিসেবে গণ্য হবে। (সহীহ বুখারী ২৩২০, ৬০১২, সহীহ মুসলিম ১৫৫২, ১৫৫৩, তিরমিযী ১৩৮২, ইবনু মাজাহ ০৮, ৩৮০৭, দারামী ২৬৫২, আহমাদ ১২৪৯৫, ১২৯৯৯, ১৩৩৮৯, ১৩৫৫৩, ১৩৫৫৪, ১৫২০২, ১৫২০১, ১৫৬১৬, ২৩৫২০, ২৭০৪৩, ২৭৩৬১, ২৭৫০৬)।

জাবির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা উম্মু মুবাশশির নামক জনৈকা আনসারী মহিলার খেজুর বাগানে গমন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এই খেজুর গাছ কি কোন মুসলিম লাগিয়েছে, না কোন কাফির? সে বলল, মুসলিম। তিনি বললেন- যে কোন মুসলিম গাছ লাগায় বা ক্ষেত করে, আর তা থেকে মানুষ কিংবা জীব-জন্তু অথবা অন্য কিছুতে খায় তবে তা তার জন্য দান স¦রূপ। ( সহীহ বুখারী ৩৮২৫, সহীহ মুসলিম ১৫৫২)।

জাবির রা. হতে এ হাদীসটির বিস্তারিত বিবরণও বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যে কোন মুসলিম (ফলবান ) গাছ লাগাবে তা থেকে যা কিছু খাওয়া হয় তা তার জন্য দান স্বরূপ, যা কিছু চুরি হয় তাও দান স্বরূপ, বন্য জন্তু যা খাবে তাও দান স্বরূপ। পাখি যা খাবে তাও দান স্বরূপ। আর কেউ যে কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করলে তাও তার জন্য দান স্বরূপ। (সহীহ মুসলিম ১৫৫২, আহমাদ ১৫২০১)। এখানে বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হল, গাছে ফল ধরলে পাখিতে খাবেই। ফসল ফললে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ কিছু তো নষ্ট করতেই পারে। কিছু অসাধু মানুষের দ্বারা ফল-ফসলের ক্ষতি হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক তো আছেই; কিন্তু এই ক্ষতিকে ক্ষতি বলেনি ইসলাম। বরং পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ যা-ই খেয়েছে, অসাধু মানুষ ও দুর্যোগে যা নষ্ট হয়েছে এসব কিছুকেই মালিকের জন্য দান বলে ঘোষণা দিয়ে বৃক্ষরোপণে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে ইসলাম ।

বৃক্ষরোপণের সাওয়াব কিয়ামত পযর্ন্ত চলমান
জাবির রা. এর হাদীসটি অন্য সূত্রেও বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা উম্মু মা‘বাদের বাগানে প্রবেশ করলেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হে উম্মু মা‘বাদ এ গাছ কে লাগিয়েছে? কোন মুসলিম না কাফির? সে বলল, মুসলিম। তিনি বললেন: কোন মুসলিম যদি কোন গাছ লাগায় আর তা থেকে মানুষ কিংবা চতুষ্পদ জন্তু অথবা পাখি ভক্ষণ করে। তবে কিয়ামতের দিন পযর্ন্ত তা তার জন্য দান স্বরূপ থাকবে। (সহীহ মুসলিম ১৫৫২, দারামী ২৬৫২, আহমাদ ১৫২০১, ২৭০৪৩, ২৭৩৬১)

পাঠক, আপনার বৃৃক্ষটি পত্র-পল্লবে, ফুলে-ফলে বিকশিত হয়ে মহীরূহে পরিণত হলে তা আপনাকেই শুধু উপকৃত করবে না, পাখিরা আশ্রয় নিবে, মৌমাছি মধু নিবে, মানুষ ও পশু-পাখি এর ফল খাবে, প্রচ- রোদে পথিকের আশ্রয় হবে। আর এই সবটুকু সাওয়াব পৌঁছে যাবে আপনার আমলনামায়। তা পৌঁছতে থাকবে কিয়ামতের দিবস পর্যন্ত। তাই বৃক্ষ রোপণ করে কিয়ামত পর্যন্ত অফুরন্ত পুণ্যের অধিকারী হতে থাকুন।

অহেতুক বৃক্ষ কর্তনের সতর্কতা
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে বৃক্ষ নিধন পরিবেশকে ভয়ংকর হুমকির মুখে ফেলতে পারে। বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে এক সময় মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে এবং তা মানবজীবনের জন্য চরম ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ কারণেই তারা বারবার নিষেধ করছেন বৃক্ষ কর্তন করতে। এবার দেখুন, আজকের আধুনিক বিজ্ঞান পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বৃৃক্ষনিধনে নিধেষ করছে; অথচ আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর আগেই ইসলাম নিষেধ করেছে অহেতুক বৃক্ষ কর্তন করতে। দেখিয়েছে বৃক্ষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার অপূর্ব দৃষ্টান্ত। এ বিষয়েই আবদুল্লাহ ইবনু হুবশী রা. থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। যে ব্যক্তি কোন বড়ই গাছ কাটবে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। ইমাম আবু দাউদ রা.কে এ হাদীসের অর্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: এ হাদীসের বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত এর দ¦ারা উদ্দেশ্য হলো: যে ব্যক্তি অকারণে বা না হকভাবে মরুভূমির কোন বড়ই গাছ কাটবে, যেখানে পথিক বা কোন প্রাণী ছায়া গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (আবু দাউদ ৫২৩৯, ৫২৪০, ৫২৪১)।

এই হাদীসে তো স্পষ্টই বর্ণিত হয়েছে অকারণে বা না হকভাবে যে এমন কোন গাছ কাটবে যার ছায়ায় পশু-পাখি বা পথিক আশ্রয় নেয় তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাহলে প্রমাণিত হলো অনর্থক ও অন্যায়ভাবে গাছ কাটা বা বৃক্ষনিধন করার শাস্তি অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া।

এমনকি মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ পরবর্তী সব খলিফা কঠোরভাবে সৈন্যদেরকে নিদের্শ দিতেন তারা যেন বিজিতদের কোন গাছপালা বা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস না করে।

এ প্রসঙ্গেই হাবীব ইবনু অলীদ হতে বণির্ত দীর্ঘ হাদীসের এ অংশটি উল্লেখযোগ্য: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৈন্যদল প্রেরণকালে সতর্ক করে বলতেন- তোমরা কোন বৃক্ষ উৎপাটন করবে না। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৯৪৩০)।

এ সংক্রান্ত অন্য হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আর তোমরা কোন গাছ উপড়াবে না, কোন খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। (সহীহ মুসলিম ১৭৩১ )।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পর আবু বকর রা. ও একই রীতি অবলম্বন করেন। সেনাপতি উসামা ইবনু যায়েদ রা. কে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- হে লোক সকল দাঁড়াও, আমি তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দিব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। এ দশটি উপদেশের ভেতর বিশেষভাবে তিনি বলেন: তোমরা খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা জ্বালিয়েও দিবে না। কোন ফলবতী গাছ কাটবে না। (মুখতাসারু তারিখি দিমাশক ১/৫২)।

এটাই হলো বৃক্ষের প্রতি ইসলামের ভালোবাসা। ইসলাম আদেশ দিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে। কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, ভয়ংকর শাস্তির হুমকি দিয়েছে অপ্রয়োজন ও অনার্থকভাবে বৃক্ষনিধনের বিষয়ে।

তাই আসুুন! সকলে মিলে সুস্থ, সুন্দর ও সবুজাভ পরিবেশ গড়ার প্রত্যয়ে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যায় উদ্যোগী হই। তা ছাড়াও এ কাজে অনন্তকালের অফুরন্ত পুণ্যের হাতছানি তো আছেই!

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ কালীগঞ্জ।
মুহাদ্দিস, আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া কাসিমুল উলুম (কওমি মাদরাসা) বলিদাপাড়া, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here