সাতক্ষীরাঃ

জমি নিয়ে বিরোধ, মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান নাকি পারিবারিক দ্বন্দ্ব কোনটির কারণে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের চারজনকে গলা কেটে নৃশংস এ হত্যাযজ্ঞ। এটির এখনও কোনো মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মা-বাবা, ভাই-বোনকে হত্যার পর ছয় মাস বয়সী শিশু মারিয়াকে ফেলে রাখা হয় মায়ের লাশের পাশে। সেখান থেকেই অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় শিশুটিকে।

এদিকে, শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার দেখিয়ে স্বপরিবারে নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলামকে আদালতে পাঠিয়েছে সিআইডি পুলিশ। তাকে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার ভোররাতে কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলিসা গ্রামের মাছের ঘের ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান (৪০), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩০), বড় ছেলে সিয়াম হোসেন (৯) ও মেঝো মেয়ে তাসমিন সুলতানাকে (৬) ঘরের মধ্যে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের সময় একই সঙ্গে থাকা ছয় মাস বয়সী ছোট মেয়ে মায়িরা সুলতানা সৌভাগ্যক্রমে খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পায়।

পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরেই ঘটেছে এ হত্যাকাণ্ড। স্থানীয়রা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল শাহিনুর রহমানের। সেটিও হতে পারে হত্যাকাণ্ডের রহস্য। তাছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ্বে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নৃশংস এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই কলারোয়া থানায় নিহত শাহিনুর রহমানের শাশুড়ি ময়না বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি মামলা করেছেন। ময়না বেগম উপজেলার উফাপুর গ্রামের রাসেল গাজীর স্ত্রী।

হেলাতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন জানান, শাহিনুর একটি ভালো ছেলে। ভদ্র ও নম্র স্বভাবের। তার উগ্র মনোভাব কখনই ছিল না। মাছের ব্যবসা করতো। এলাকার একটি মানুষও তাকে খারাপ বলতে পারবে না।

কি কারণে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনটি কারণ উঠে আসছে আলোচনায়। একটি জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ, অন্যটি মাদক ব্যবসায় বিরোধিতা করা। আরেকটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক লেনদেনের বিরোধ। তবে আমরা মনে করছি, জমি নিয়ে বিরোধে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটবে, ঘটনাটি আসলে তেমন পর্যায়ের ছিল না। তাছাড়া অর্থনৈতিক লেনদেনকে ঘিরেও এতবড় হত্যাযজ্ঞ চালানটিও অস্বাভাবিক। এখন মাদকের বিরোধিতা করা এটিই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন বলেন, শাহিনুর রহমানরা চার ভাই। বড় ভাই মারা গেছেন। তার পরের জন মেঝো ভাই রয়েছেন মালয়েশিয়াতে। সেজো ভাই শাহিনুর রহমান মাছের ব্যবসা করতেন। ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম মাদকের ব্যবসা করতেন। একবার এক মাদক মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। এছাড়া ইতোপূর্বে একবার পুলিশের হাতে আটকও হয়েছে। ছোট ভাইয়ের এসব কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতেন স্বপরিবারে খুন হওয়া শাহিনুর রহমান। এলাকার মানুষ মনে করছেন, মাদকের এই বিরোধিতার কারণে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের হাতে স্বপরিবারে খুন হয়েছেন তারা। পুলিশ তার ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে।

ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কথার সঙ্গে মিলে যায় স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিমতও। তবে হত্যাকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার সকালে নিহতের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, বাড়িতে মা ও বড় ভাইয়ের পরিবারের সদস্যরা আমরা এক সঙ্গে থাকি।

বুধবার মা আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রাতে আমি বাড়িতে পাশের আরেকটি ঘরে ছিলাম। ভোররাতে পাশের ঘর থেকে বাচ্চাদের গোঙানি শুনতে পাই। এরপর গিয়ে দেখি তাদের ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। দরজা খুলে দেখি মর্মান্তিক এ দৃৃশ্য। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে আছে ভাই, ভাবি, ভাতিজা ও ভাতিজির লাশ। প্রথমদিকে বাচ্চারা বেঁচে ছিল তবে কিছুক্ষণ পর মারা যায়। ছয় মাস বয়সী মারিয়া পড়ে ছিল মায়ের লাশের পাশে।

তিনি দাবি করেন, বড় ভাই শাহীনুর নিজস্ব ৭-৮ বিঘা জমিতে পাঙাস মাছ চাষ করতেন। গত ২২ বছর ধরে তাদের পারিবারিক সাড়ে ১৬ শতক জমি নিয়ে প্রতিবেশী ওয়াজেদ কারিগরের ছেলে আকবরের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। এ মামলা ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

তবে এখনই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মুখ খুলছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কলারোয়া থানায় হত্যা মামলাটি নথিভুক্ত হওয়ার পর সেটি হস্তান্তর করা হয়েছে সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশে।

সাতক্ষীরা সিআইডি পুলিশের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আনিচুর রহমান জানান, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনও বিস্তারিত বলার মতো কিছু হয়নি। তবে এ মামলায় নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখিয়ে শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকার এ ঘটনায় এখনও বিস্তারিত বলার মতো কিছু হয়নি। তদন্ত চলছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here