ঢাকা ০৩:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিরক্ষরমুক্ত ইউনিয়ন গড়তে ‘কৃষকের বন্ধু’ এমদাদের নৈশস্কুল

Reporter Name

শাহরিয়ার আলম সোহাগঃ

গ্রামের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। কিন্তু সেখান থেকে কোন বেতন পান না তিনি। বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে মাসে ১০ হাজারের মত টাকা উপার্জন করেন। এই টাকা দিয়ে নিজের সংসার ও কৃষকদের মাঝে খরচ করেন তিনি। বছরের পর বছর কৃষকদের রক্ষায় কাজ করছেন তিনি। বলছিলাম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কাজী আব্দুল ওয়াহেদের ছেলে কাজী এমদাদুল হকের কথা। সার্বক্ষনিক কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকায় ইতিমধ্যে পেয়েছেন ‘কৃষকের বন্ধু’ খেতাব।

সম্প্রতি শীতের এক রাতে উপজেলার পারিয়াট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে জ্বলছে আলো। সেখানে গেলে দেখা যায়, প্রায় ২০ জন কৃষকের সামনে সিলেট, চক ও ব্যাঞ্জনবর্ণের বই। আর তাদের শিক্ষক এমদাদ ব্লাকবোর্ডে অক্ষর লেখা শেখাচ্ছেন। সেখানেই এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় কাজী এমদাদুল হকের।

তিনি জানান, তিনি ১৯৮৮ সালে কোলাবাজার ইউনাইটেড হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে খুলনা আজম খাঁন কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিএ পরীক্ষা শেষে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান জামালপুর। চাকরি ছেড়ে চলে আসেন আবার গ্রামে। নিজে কৃষি কাজের পাশাপাশি গ্রামের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। সেখানে বেতন না থাকায় বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে মাসে হাজার দশেক টাকা আয় করেন। এরমধ্যে ৬ হাজার টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেন। বাকি টাকা কৃষকদের পেছনে ব্যয় করেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তার সংসার।

কৃষকের এই বন্ধু বলেন, কৃষকরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য আমাদের সবারই কিছু করা উচিৎ। তারা সুস্থ থাকলে দেশ ভালো থাকবে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। ২০০৪ সাল থেকে এই ইউনিয়নকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য নৈশস্কুল চালু করেছেন। ইতিমধ্যে ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের ১৮টি স্থানে নৈশস্কুলের মাধ্যমে ৬ শতাধিক অক্ষরজ্ঞানহীন কৃষকদের পাঠদান করিয়েছেন। বর্তমানে ১৯তম স্থানে নৈশস্কুলে পাঠদান পরিচালনা চলছে। কেউ যেন আর টিপসই ব্যবহার না করেন। অন্তত নিজের নাম, পিতার নাম,তাদের ঠিকানা লিখতে পারেন এইজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।

শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, প্রখর রোদে কাজ করার সময় অনেক কৃষকের মাথায় কিছু থাকে না। এমন প্রায় এক কাজার কৃষককে মাথাল সরবরাহ করেছি। এছাড়া জমিতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করার কৃষকরা নাকে ও মুখে কিছু ব্যবহার করেন না। তিনি সেইসব কৃষকদের মাস্ক প্রদান করেন। এছাড়াও কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে হাত-পা ধোয়ার অভ্যাস করাতে কৃষকদের মাঝে সাবানও তুলে দেন। এসব তিনি কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের তিন মাস পরপর ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং করেন তিনি। এছাড়াও তিনি গরীব ও দুস্থ কৃষকদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।

কথা হলো কাজী এমদাদুল হকের নৈশস্কুলে পারিয়াট গ্রামের রাজ্জাক মালিথা (৫৫) নামের এক কৃষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে টিপসই দিয়ে কাগজপত্রের কাজ করতাম। ২ মাস এখানে আসছি। সারাদিন মাঠে কাজ করার পর এশার নামাজের সময় এখানে আসি। এখন নিজের নাম, বাবা ও মায়ের নামসহ ঠিকানা লিখতে পারি।

আরেক কৃষক ওসমান আলী সরদার (৬০) বলেন, এমদাদ ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। আমাদেরকে অক্ষর লেখা শেখানোর পাশাপাশি তিনি মাথাল, সাবান ও মুখের মাস্ক বিনামূল্যে দেন।

তিনি বলেন, অক্ষরজ্ঞান না থাকায় কৃষি বিভাগ থেকে সচেতনতামূলক যেসব লিফলেট দেয়া হয়, সেগুলো কৃষকরা পড়তে পারেন না। তাই ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের বিভিন্ন স্থানে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই।

৩নং কোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন বলেন, এমদাদ যা করছেন, তা জনপ্রতিনিধি হয়েও আমরা করতে পারি না। তিনি যে টাকা উপার্জন করেন, তা পরিবারের পেছনে কম খরচ করে এলাকার মানুষের পেছনে ব্যয় করেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ জাহিদুল করিম বলেন, এমদাদুল হকের কাজে স্থানীয় কৃষি বিভাগ মুগ্ধ। তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এমদাদুল হকের বাড়িতে কৃষি পাঠাগার করে দেয়া হয়েছে। সেখানে একটি আলমারিসহ কিছু বইও দেয়া হয়েছে।

About Author Information
আপডেট সময় : ১২:০৭:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০
৮৩৫ Time View

নিরক্ষরমুক্ত ইউনিয়ন গড়তে ‘কৃষকের বন্ধু’ এমদাদের নৈশস্কুল

আপডেট সময় : ১২:০৭:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২০

শাহরিয়ার আলম সোহাগঃ

গ্রামের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। কিন্তু সেখান থেকে কোন বেতন পান না তিনি। বাড়িতে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে মাসে ১০ হাজারের মত টাকা উপার্জন করেন। এই টাকা দিয়ে নিজের সংসার ও কৃষকদের মাঝে খরচ করেন তিনি। বছরের পর বছর কৃষকদের রক্ষায় কাজ করছেন তিনি। বলছিলাম ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কাজী আব্দুল ওয়াহেদের ছেলে কাজী এমদাদুল হকের কথা। সার্বক্ষনিক কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকায় ইতিমধ্যে পেয়েছেন ‘কৃষকের বন্ধু’ খেতাব।

সম্প্রতি শীতের এক রাতে উপজেলার পারিয়াট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে জ্বলছে আলো। সেখানে গেলে দেখা যায়, প্রায় ২০ জন কৃষকের সামনে সিলেট, চক ও ব্যাঞ্জনবর্ণের বই। আর তাদের শিক্ষক এমদাদ ব্লাকবোর্ডে অক্ষর লেখা শেখাচ্ছেন। সেখানেই এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় কাজী এমদাদুল হকের।

তিনি জানান, তিনি ১৯৮৮ সালে কোলাবাজার ইউনাইটেড হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৯০ সালে খুলনা আজম খাঁন কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিএ পরীক্ষা শেষে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে চলে যান জামালপুর। চাকরি ছেড়ে চলে আসেন আবার গ্রামে। নিজে কৃষি কাজের পাশাপাশি গ্রামের একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। সেখানে বেতন না থাকায় বাড়িতে ছাত্র পড়িয়ে মাসে হাজার দশেক টাকা আয় করেন। এরমধ্যে ৬ হাজার টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেন। বাকি টাকা কৃষকদের পেছনে ব্যয় করেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তার সংসার।

কৃষকের এই বন্ধু বলেন, কৃষকরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের জন্য আমাদের সবারই কিছু করা উচিৎ। তারা সুস্থ থাকলে দেশ ভালো থাকবে। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে কৃষকদের পাশে থাকার চেষ্টা করি। ২০০৪ সাল থেকে এই ইউনিয়নকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য নৈশস্কুল চালু করেছেন। ইতিমধ্যে ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের ১৮টি স্থানে নৈশস্কুলের মাধ্যমে ৬ শতাধিক অক্ষরজ্ঞানহীন কৃষকদের পাঠদান করিয়েছেন। বর্তমানে ১৯তম স্থানে নৈশস্কুলে পাঠদান পরিচালনা চলছে। কেউ যেন আর টিপসই ব্যবহার না করেন। অন্তত নিজের নাম, পিতার নাম,তাদের ঠিকানা লিখতে পারেন এইজন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।

শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, প্রখর রোদে কাজ করার সময় অনেক কৃষকের মাথায় কিছু থাকে না। এমন প্রায় এক কাজার কৃষককে মাথাল সরবরাহ করেছি। এছাড়া জমিতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করার কৃষকরা নাকে ও মুখে কিছু ব্যবহার করেন না। তিনি সেইসব কৃষকদের মাস্ক প্রদান করেন। এছাড়াও কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে হাত-পা ধোয়ার অভ্যাস করাতে কৃষকদের মাঝে সাবানও তুলে দেন। এসব তিনি কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে দিয়ে থাকেন। ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের তিন মাস পরপর ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং করেন তিনি। এছাড়াও তিনি গরীব ও দুস্থ কৃষকদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।

কথা হলো কাজী এমদাদুল হকের নৈশস্কুলে পারিয়াট গ্রামের রাজ্জাক মালিথা (৫৫) নামের এক কৃষকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে টিপসই দিয়ে কাগজপত্রের কাজ করতাম। ২ মাস এখানে আসছি। সারাদিন মাঠে কাজ করার পর এশার নামাজের সময় এখানে আসি। এখন নিজের নাম, বাবা ও মায়ের নামসহ ঠিকানা লিখতে পারি।

আরেক কৃষক ওসমান আলী সরদার (৬০) বলেন, এমদাদ ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। আমাদেরকে অক্ষর লেখা শেখানোর পাশাপাশি তিনি মাথাল, সাবান ও মুখের মাস্ক বিনামূল্যে দেন।

তিনি বলেন, অক্ষরজ্ঞান না থাকায় কৃষি বিভাগ থেকে সচেতনতামূলক যেসব লিফলেট দেয়া হয়, সেগুলো কৃষকরা পড়তে পারেন না। তাই ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের বিভিন্ন স্থানে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই।

৩নং কোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন বলেন, এমদাদ যা করছেন, তা জনপ্রতিনিধি হয়েও আমরা করতে পারি না। তিনি যে টাকা উপার্জন করেন, তা পরিবারের পেছনে কম খরচ করে এলাকার মানুষের পেছনে ব্যয় করেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ জাহিদুল করিম বলেন, এমদাদুল হকের কাজে স্থানীয় কৃষি বিভাগ মুগ্ধ। তাই কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এমদাদুল হকের বাড়িতে কৃষি পাঠাগার করে দেয়া হয়েছে। সেখানে একটি আলমারিসহ কিছু বইও দেয়া হয়েছে।