ফারুক নোমানীঃ

অর্ধ পৃথিবীর শাসক খলিফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর কাছে একজন পিতা তার অবাধ্য সন্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করলেন। খলিফা তলব করলেন সেই অবাধ্য সন্তানকে। অপরাধির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছেলেটি খলিফাকে জিজ্ঞেস করল, আমিরুল মু’মিনীন, পিতার উপর সন্তানের কী কী অধিকার ও আবশ্যকীয় কর্তব্য জড়িয়ে আছে? উমর রা. বললেন-‘সন্তানের জন্য পিতা একজন মমতাময়ী মা নির্বাচন করবেন। তাকে কুরআনুল কারীম শিক্ষা দিবেন, নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিখাবেন, তাকে একটি সুন্দর নাম রাখবেন।’ ছেলেটি বললেন হে আমীরুল মু’মিনীন, আমার পিতা এ সকল কর্তব্যের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করেননি। তিনি আমার জন্য এমন একজন মা নির্বাচন করেছেন যিনি আমার ব্যাপারে যত্নবান নন, আর আমার নাম রেখেছেন তিনি ‘জুয়ল’ (যার অর্থ পোকা)। আমাকে তিনি কুরআনুল কারীম, নীতি ও নৈতিকতা, সভ্যতা ও শিষ্টাচারের কিছুই শেখাননি। উমর রা. তখন লোকটিকে ধমক দিয়ে বললেন-‘যাও, তোমার সন্তান তোমার অবাধ্য হবার আগেই তুমি তার প্রতি অন্যায় ও অবিচার করেছো!’

পাঠক, সন্তান পিতার অবাধ্য হওয়ার ঘটনা এ সমাজে বিরল নয়, অধিকাংশ পরিবারই এ সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি করুণভাবে। অথচ নিরপেক্ষ ও গভীর দৃষ্টিতে দেখলে আমরা যা দেখি তা হলো- পিতার কর্তব্য পালনে অবহেলা ও অসচেতনতা। বাচ্চারা দেখে দেখে শেখে ও শুনে শুনে শেখে। তাই বাবাকে যদি সন্তান বিড়ি খেতে দেখে তাহলে অবশ্যই সে কোন কাঠি বা কলম নিয়ে সুখটানের অনুশীলন করবে। বাবাকে অশুদ্ধভাষায় কথা বলতে ও অশ্লীল গালিগালাজ করতে শুনলে- সন্তান কোন কষ্ট ছাড়াই অশুদ্ধভাষায় অভ্যস্থ হয়ে উঠবে উত্তরাধিকার সূত্রে, গালিশিল্পে সন্তান পিতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং সন্তানের সামনে পিতাকে অনেক কিছুই বর্জন করে চলতে হয়। কারণ যেভাবে পিতাকে কথা বলতে দেখবে, যে কাজ করতে দেখবে বাচ্চারা তাতেই অভ্যস্থ হয়ে পড়বে। এটাই তাদের রক্তে -মাংশে একাকার হয়ে মিশে যাবে। আরবি প্রবাদ আছে- ‘শৈশবের শিক্ষা পাথরে খোদাই করে লেখার মত।’ পাথরে খোদাইকৃত লেখা যেমন মুছে যায় না -তেমনি ছোটবেলার শিক্ষাও ব্যক্তির হৃদয়ে থাকে চির গ্রথিত। সুতরাং বাচ্চাকে আপনি যাই শিখাবেন চিরদিন সে তাই বুকে লালন করবে। তাই আপনাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে -আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ আপনি কেমন দেখতে চান!

একজন পিতা একজন শিক্ষক :
একজন পিতা তার সন্তানকে যেমন বিশুদ্ধভাষায় কথা বলা শেখাবেন, তেমনি তাকে সুন্দর আচার-ব্যবহার, চারিত্রিক মাধুর্যও শিক্ষা দিবেন। এক্ষেত্রে একজন পিতা একজন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করবেন। তাই তো বিজ্ঞরা বলেন- একজন আদর্শ পিতা হাজার শিক্ষকের চে’ উত্তম। সুতরাং পিতাকে সন্তানের সার্বিক বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আর তার সামনে প্রতিটি আচরণ করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। কারণ বাচ্চারা যে কাজ যেভাবে করতে দেখবে সেভাবেই করবে।

বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলুন :

মা ও বাবাকে যে ভাষায় ও যে টানে কথা বলতে শুনবে সন্তানও তা রপ্ত করে ফেলবে। তাই নোয়াখালীর বাচ্চারা যশোরের ভাষায় কথা বলতে পারে না। তেমনিভাবে যশোরের বাচ্চারা বরিশালের টান সম্পর্কেও থাকে পুরো বেখবর। কেননা মা-বাবার মুখ যেভাবে শব্দের উচ্চারণ শুনেছে ওরা সেভাবেই শিখেছে। আর ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা আল্লাহর এক অন্যতম নিয়ামত। কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে: ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র।’ (সূরা রূম: ২২) সুতরাং বিশুদ্ধভাষায় কথা বলা একটি গুরুদায়িত্বও বটে। নবীজী সা. নিজে বিশুদ্ধ আরবিতে কথা বলতেন। তিনি বলেছেন: আমাকে দান করা হয়েছে সর্বমর্মী বচন। (সহীহ মুসলিম: ৫২৩) তাঁর সাহাবীগণ ও পরবর্তী প্রজন্মও এ ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন। এটা নবীজীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। হযরত নাফে বলেন:‘ইবনু ইমর রা. তাঁর সন্তানকে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার কারণে প্রহার করতেন।’ ইমাম বুখারী আল আদাবুল মুফরাদে ‘অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারে প্রহার’ অনুচ্ছেদে হাদসিটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনু তাইমিয়া রা. বলেন- ‘পূর্বসূরীরা ভাষায় ভুল করলে তাদের সন্তানদের শাসন করতেন।’ (মাজমাউল ফাতওয়া ৩১/২৫২) ইমাম যুহরি রাহি. বলেন: আমার মতে বিশুদ্ধ ভাষার চেয়ে বড় আভিজাত্যের বস্তু আর কিছু নেই।’ (হিলইয়া ৩/৩৬৪, আলমুরুআ: ৪৩) তিনি আরো বলেন-‘বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যের অন্তর্ভুক্ত।’ (বাহজাতুল মাজালিস ২/১/৬৪৩)

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন-‘ভাষার সংশোধন ও তার সঠিক ব্যবহার সবচে’ বড় আভিজাত্য।’ (আলমুরুআ: ৭০) আবদুল মারিক বিন মারওয়ান তার সন্তানদের মুখে অশুদ্ধ ভাষা শুনে অনেক মর্মাহত ও ব্যথিত হন এবং বলেন এটা ওয়ালিদের জন্য অশোভনীয়। তিনি আরো বলেন- ‘ভাষার ভুল কাপড়ের ছিদ্র বা ছিন্নতা ও মুখে গুটিবসন্তের চেয়েও জঘন্য।’ (আলফাখারী: আলআদাবুস সুলতানিয়া ১/৪৫) তারপর গ্রন্থকার বলেন-‘অশুদ্ধ ভাষা তাদের নিকট অতি ঘৃণ্য বিষয় ছিল।’

একবার যিয়াদ তার সন্তান উবায়েদকে মুআবিয়া রা. এর নিকট পাঠালেন। সার্বিক পর্যবেক্ষণের পর মুআবিয়া রা. যিয়াদের কাছে চিঠিতে লেখেন-‘তোমার ছেলে যেমন বলেছিলে ঠিক তেমনি, তবে একটু ভাষাটা ঠিক করে দিও।’ (আলবায়ান ওয়াত তাবয়ীন ১/১৪৫)।

পাঠক, ইসলামে বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে এভাবেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই সন্তানকে তার শৈশব থেকেই বিশুদ্ধ ভাষায় অভ্যস্থ করে তুলতে হবে।

মার্জিত আচরণ শেখান :

কথায় আছে -‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়।’ ব্যক্তির আচার- ব্যবহার বলে দেয় যে, সে কেমন বংশের লোক। এটাকে আরো খোলাসা করে বললে বলতে হবে- মানুষের ব্যবহারই তার পিতা/মাতার ব্যবহারের কথা জানান দেয়। জানিয়ে দেয় তার পিতা তাকে ভালো ব্যবহার শিখিয়েছে কিনা? মনে রাখতে হবে শৈশব হলো জীবন গঠনের মূল সময়। অনেক অভিভাবক ছেলের মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তার ক্যারিয়ার গঠনের চিন্তা করেন। অথচ ক্যরিয়ার গড়ার মূল সময় তো হলো তার শৈশবই। তাই শৈশবকে নরম কাদার সাথে তুলনা করা চলে। নরম কাদাকে যেমন করে ঘুরাবেন, যেদিকে ঘুরাবেন তা ঘুরবে। কিন্তু কাদা শক্ত হয়ে গেলে! তা আপনার হাতের নির্দেশনা মানবে না, জোর করলে ভেঙে যাবে। ঠিক একই কথা সন্তানের ব্যাপারেও। অভিভাবকদের অনেকই সন্তানের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেন, বলেন- অনেক বলেও পারছি না তাকে পথে আনতে। অথচ শৈশবে যখন ছেলেটি নরম কাদার মত ছিল তখন কিন্তু অভিভাবক তার সুন্দর আচরণ ও মার্জিত ব্যবহারের শিক্ষা দিতে অবহেলা করেছেন। পিতার দায়িত্ব হলো সন্তানকে শেখাবেন কীভাবে বড়দের সাথে কথা বলতে হয়, কীভাবে ছোটদেরকে স্নেহ করতে হয়, কীভাবে মিশতে হয় সমসাময়িকদের সাথে। আরো একটি বড় বিষয় হলো মৌখিক নীতিকথার থেকে বাস্তব অনুশীলনই বাচ্চাদের জন্য বেশি ফলপ্রসু। তাই আপনার পিতা-মাতা জীবিত থাকলে তাদের সেবা করুন, আপনি বড়দের সাথে শ্রদ্ধা ও ভক্তির আচরণ করুন, মানুষের সাথে তার মর্যাদা অনুপাতে মার্জিত আচরণ করুন! দেখবেন, আপনার সন্তান আপনার দেখাদেখি এটায় অভ্যস্থ হয়ে উঠবে। আপনার বৃদ্ধ পিতাকে সেবা করতে দেখলে আপনার সন্তান আপনার সেবায় নিয়জিত থাকবে। আপনার অবাধ্য হবে না। এজন্যই তো বলা হয়, একজন আদর্শ পিতা হাজার শিক্ষকের চে’ উত্তম। কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা বড়ই করুণ। তাই সন্তানকে মার্জিত আচরণ ও উত্তম চরিত্র শেখানোর এ গুরুদায়িত্ব পালন পিতাকেই করতে হবে।

ধর্মের মৌলিক শিক্ষা দান করুন :

পিতার উপর অর্পিত বড় দায়িত্বটি হলো সন্তানকে ধর্মের মৌলিক শিক্ষা দান করা। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত হওয়া সকলের উপর আবশ্যক নয়, তবে সকলকেই ধর্মের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের আদেশ দিয়েছে ইসলাম। সাহাবী আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন: প্রত্যেক মুসলিমের উপর ইলম (ধর্মের জ্ঞান) অর্জন করা ফরয। (ইবনু মাজাহ :২২৪, আল মু’জামুল আওসাত: ৯, ২০০৮)।

একজন আলেম বা ধর্মীয় শাস্ত্রে যিনি পণ্ডিত তাঁর অসীম মর্যাদা ও উচ্চ সম্মানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে কুরআনুল কারীম ও নবীজীর হাদীস শরিফে। প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষাটা সকলের উপরই যে আবশ্যক এটা বুঝাতেই কুরআনুল কারীমের প্রথম আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। মনে রাখার বিষয় যে, ইসলামের প্রথম ওহী বা বাণীটি ইবাদত বা কোন নীতিমালার উপর অবতীর্ণ হয়নি, সেখানে মূলত পড়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন-‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক: ০১) এ আয়াতটি দ্বারাই স্পষ্ট ইসলাম কতটা গুরুত্ব দিয়েছে ইলম শিক্ষা করার। দেশ ও দশের কল্যাণে আপনার সন্তানকে জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে একজন নীতিবান অফিসার হতে হলে, একজন সৎ ও আদর্শবান সমাজসেবক হতে হলে অবশ্যই তার ভেতরে ধর্মের প্রাথমিক শিক্ষাটি থাকতে হবে। আপনার সন্তানের ভেতরে যদি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মের শিক্ষা থাকে তাহলে সে টাকার পাহাড়ের নিচে বসেও পরের একটি টাকা আত্মসাৎ করবে না। ক্ষমতা ও শাসনের অধিকার অর্জন করেও কোন মানুষকে অহেতুক কষ্ট দিবে না। বড় ডাক্তার হয়েও চিকিৎসার নামে গরিবের রক্ত চুষে খাবে না। কারণ তার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মীয় শিক্ষা তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তাই সারাটি জীবন মানুষের প্রীতি ও ভালোবাসা নিয়ে সে বাঁচবে। আর পরকালেও আল্লাহর কাছে পাবে মহাপুরষ্কার। সন্তানকে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করলে সে অন্তত ধর্মীয় কারণে পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না। তাদের মনে কষ্ট দিবে না। আর সে তার নিজের জীবনটা পরিচালনা করতে পারবে স্রষ্টার সন্তুষ্টি মোতাবেক। আবার আপনার মৃত্যুর পর এই সন্তানই হবে আপনার মুক্তির একটি বড় উপায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর সন্তান আল্লাহর দরবারে হাত তুলে আপনার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে দুআ করবে। আর নেককার সন্তানের দুআ বিফলে যাবে না কখনো। কিন্তু সন্তানকে যদি ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেন তাহলে হয়ত বছরে একবার আপনার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করবে কিছু হাফেয এনে, কোন মাওলানা-মৌলভী ভাড়া করে এনে আপনার জন্য দুআ করাবে। আপনার সন্তান নিজে আপনার জন্য দুআ করলে সে দুআ ব্যর্থ হত না কখনো, কিন্তু টাকা দিয়ে কারোর মাধ্যমে দুআ করালে সে দুআ কবুল হতেও পারে আবার নাও পারে। তাই আপনার নিজের ও সন্তানের কল্যাণে তাকে ইলম শিখান। অন্তত ধর্মের প্রাথমিক জ্ঞান থেকে তাকে বঞ্চিত করবেন না।

মনে রাখবেন, সন্তানকে অন্তত প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও তার ভেতরে ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি করা পিতার একটি বড় দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্বে সামান্যতম অবহেলা পিতা ও সন্তান উভয়ের ইহকাল ও পরকালকে বড় হুমকির ভেতরে ফেলতে পারে।

বড়দের জীবনী শোনান :

আপনার সন্তানকে স্বপ্ন দেখতে শেখান। তবে ঘুমের ভেতরের স্বপ্ন নয়, জেগে জেগে তাকে স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করুন। তাকে দেখান জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন। সেরাদের সেরা হওয়ার আশা তার চোখে জ্বালিয়ে দিন। এই শৈশব থেকেই অনেক বড় হবার দুর্বার বাসনা তার হৃদয়ে সৃষ্টি করুন। তার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে দিন; দেখবেন আপনার সন্তান বাকি জীবন সেই লক্ষ্যপাণে ছুঁটে চলবে। এজন্য তাকে শোনান বড়দের গল্প। জীবনে সফলতা যাঁদের পদচুম্বন করেছে, যাঁরা হয়েছেন পৃথিবীতে সেরাদের সেরা। বিখ্যাত। মানবহৃদয়ে মুকুটবিহীন সম্রাট।

বাচ্চাদের ঘুমানোর জন্য শিয়াল-বেজীর গল্প না শুনিয়ে শোনান মহামনীষীদের ছোটবেলার গল্প। বাচ্চাকে বলুন, দেখ বাবা তিনিও ছিলেন একদিন তোমার মত ছোট্ট, কিন্তু লেখা পড়া শিখে আজ সারা পৃথিবীর মানুষের মনে আসন গেড়েছেন। তুমিও যদি এমন হতে পার, তাহলে সারা পৃথিবী তোমাকে স্মরণ করবে, মৃত্যুর পরও তুমি শত শত বছর মানব হৃদয়ে থাকবে চিরঞ্জীব হয়ে। আপনার সন্তান তাহলে অনুপ্রাণিত হবে। বড় হবার প্রত্যয় গ্রহণ করবে। চোখে-মুখে তার বড় হবার প্রত্যাশা জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। একদিন সে বড় হবে। আপনার মুখ উজ্জ্বল করবে। তাই তাকে ছোট থেকেই বড়দের গল্প শোনান ।

বই পড়তে ও বই কিনতে উৎসাহিত করুন :

সন্তানদেরকে আমারা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে নানা উপহার সামগ্রী কিনে দিই। সেগুলো নিয়েই ওরা ব্যস্ত থাকে। খেলায় সময় পার করে। তবে বাচ্চার ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আমরা সেই শৈশবেই তাদের হাতে খেলনার সাথে সাথে বইও তুলে দিতে পারি। বই ছিঁড়ে ফেলুক, নষ্ট করে ফেলুক, সমস্যা নেই। আপনার সন্তান বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে উঠবে সেই অবুঝ বয়স থেকেই। এর প্রভাব থাকবে তার বাকি জীবনে। যখন অক্ষর চেনার উপযুক্ত হবে তাকে শিশুতোষ গ্রন্থ কিনে দিন। বানান করে করে পড়ান। বাচ্চাকে যেভাবে খেলনা কিনতে দোকানে নিয়ে যান, তেমনিভাবে মাঝে মাঝে লাইব্রেরীতেও নিয়ে যান। ওকে ওর পছন্দের বইটি কিনে দিন। পড়তে ও বুঝতে নাই বা পারুক, কিন্তু বই কেনা ও পৃষ্ঠা উল্টানোটা তার পরবর্তী জীবনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করবে। আর এই বই পড়া বই কেনার অভ্যাস তাকে পৌঁছে দিবে সফলতার সর্বোচ্চ স্তরে। ইতিহাস আমাদেরকে এটাই বলে।

অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখুন :
সন্তানকে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা ও অনুশীলনের সাথে সাথে তাকে মন্দ স্বভাব থেকে বিরত রাখুন। অবুঝ বয়সেই তার মনে মন্দের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করুন। তার অন্তরে বদ্ধমূল করে দিন যে, মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যুককে আল্লাহ খুব ঘৃণা করেন। পাপীকে যেমন দুনিয়াতে মানুষ খারাপ ভাবে, তেমনি আল্লাহর কাছেও সে এমন নিকৃষ্ট। তাকে বলুন, পরের জিনিস বিনা অনুমতিতে ধরতে নেই। কারো মনে কষ্ট দিলে আল্লাহ নারাজ হন। এভাবে আপনি সন্তানকে মন্দ স্বভাব থেকে বিরত থাকার যে বাস্তব অনুশীলন করাবেন সেটা তার সারাজীবনের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে। বড় হয়েও সে আর খারাপ কাজ করতে সাহস করবে না।

পিতা যখন বন্ধু :
একজন আদর্শ পিতা যেমন সন্তানের আদর্শ শিক্ষক, তেমনি তিনি তার অকৃত্রিম বন্ধুও। পিতা যতই সন্তানের কাছে বন্ধুর মতো হয়ে উঠবেন ততটাই সম্ভাবনাময় হয়ে উঠবে সন্তানের ভবিষ্যৎ। নির্মম বাস্তবতা হলো, এখনো কিছু পিতা আছেন যারা শুধু শাসন করতেই জানেন। পরম মমতায় সন্তানের ভুল সুধরে দেয়া যাদের অভিধানে নেই । সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তিনি দেখলেও তা দিবাস্বপ্নই থেকে যায়। কারণ শাসনের ভয়ে পিতার কাছে মনের কথাটি সন্তান বলতে পারে না অনেক সময়। আর এই না পারার কারণেই সন্তানের ভেতর সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারেই থাকছেন পিতা। যা ক্রমান্নয়ে উভয়ের মাঝে ফারাক সৃষ্টি করে। যেটা দুজনের জন্যই মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই আদর্শ পিতাকে অবশ্যই সন্তানের কাছে একজন অকৃত্রিম বন্ধু হতে হবে।

কর্মময় ব্যস্তজীবনে সাধারণত পিতা থাকেন সারাদিন জীবিকার তাগিদে ঘরের বাহিরে। দিন শেষে বাড়িতে ফেরেন ক্লান্ত দেহ নিয়ে। তারপরও একজন সচেতন পিতা অবশ্যই সন্তানকে একান্তভাবে প্রতিদিন কিছুটা সময় দিবেন। তার মনসিকতা ও সুস্থরুচিবোধ তৈরির জন্যে। সন্তানকে এই শৈশবে মোবাইল ও টেলিভিশনের কাছে ছেড়ে না দিয়ে আপনি ওকে সময় দিন। ওর সাথে প্রতিদিন কিছুটা সময় হাঁটুন। খেলা করুন। গল্প করুন। দেখবেন আপনার সন্তান আপনাকে তার খেলার সাথী ভাবতে শুরু করেছে। একজন বন্ধুর কাছে যেভাবে মনের কথা খুলে বলা যায় সেভাবেই আপনার কাছে তার সবকিছুই শেয়ার করছে। আপনার বিবেক-বিবেচনা দিয়ে তাকে মমতাভরে সভ্যতা ও মার্জিত আচরণ শেখান । ওর ভেতর কোন অপ্রীতিকর আচরণ লক্ষ করলে কৌশলে তা শুধরে দিন।

মনে রাখবেন, এই সন্তানই আপনার ভবিষ্যৎ। তাই সন্তানকে শৈশব থেকে যেভাবেই তৈরি করবেন, ও সেভাবেই বেড়ে উঠবে। জীবনের ভিত্তিস্থাপন করবে আপনার শেখানো ও দেখানো পদ্ধতিতেই। তাই সন্তানকে নিয়ে ভাবুন। তার আলোকিত জীবনের জন্য নিজে সচেতনতা ও বিচক্ষণতা অবলম্বন করুন।

লেখক: ইমাম, মেইন বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ কালীগঞ্জ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here