ফারুক নোমানীঃ

সারা পৃথিবীতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। অন্যান্য সচেতন রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশেও এ কারণে সর্বপ্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানকে বিরতি ঘোষণা করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এই কর্মবিরতি গণসচেতনতার জন্য বড়ই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এ বিরতি আমরা শুয়ে বসেও পার করতে পারি, আবার ভালো কোন কাজেও ব্যয় করতে পারি এই দীর্ঘ সময়। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাড়িতে বসেই এ সময়ে আমরা নানা পুণ্যের কাজও করতে পারি প্রতিনিয়ত। এ জন্য প্রয়োজন সময়ের মূল্য সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা। স্কুলে ‘সময়ের মূল্য’ নিয়ে রচনা সকলে লিখলেও বাস্তবে কিন্তু সময়কে মূল্যায়ন আমরা খুব কমই করি। শুয়ে বসে, টিভি সিনেমা, ফেসবুক ইউটিউব, চায়ের দোকান ও বন্ধুদের আড্ডায় হারিয়ে যায় আমাদের জীবনের বড় একটি অংশ। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এটা নিয়ে আমাদের যেমন নেই কোন আফসোস অনুশোচনা, তেমনি নেই কোন পদক্ষেপ ও সচেতনতা। ইসলামে সময়কে মূল্যায়ন করার বিষয়টি বাদ দিলেও যদি বৈশ্বিক অবস্থাটা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব- বিদেশীরা আমাদের এই অলস সময় পার করা দেখে শুধু অবজ্ঞায় হাসেই না, বরং আফসোসও করে। আমরা এই অলস সময় পারের মাধ্যমে নিজেদের ভেতরে থাকা বিপুল সম্ভাবনাকে যেমন হত্যা করছি, তেমনি দেশ ও জাতিকে যা দেবার কথা ছিল আমার তা থেকেও করছি বঞ্চিত।

ইসলামে সময়ের মূল্য:

সময়ের মূল্য নিয়ে ইসলাম যেমন দীর্ঘ আলোচনা করেছে, অন্য কোন ধর্মে তার দৃষ্টান্ত বড়ই বিরল। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ সময়ের মহত্ব ও গুরুত্ব বোঝাতে একাধিক জায়গায় সময়ের শপথ করেছেন। আল্লাহর জন্য শপথ করার কোন প্রয়োজন নেই, তিনি যেটা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। তারপরও তিনি সময়ের গুরুত্ব বোঝাতে কসম করেছেন সময়ের বিভিন্ন স্তরের। শপথ করেছেন রাত-দিন, সকাল-দুপুর ও ভোরের। আল্লাহ বলেন- ‘সময়ের কসম, নিশ্চয় সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থতায় নিপতিত।’ (সূরা আসর: ১-২)

‘কসম রাতের, যখন তা ঢেকে দেয়। কসম দিনের, যখন তা আলোকিত হয়।’ (সূরা লাইল: ১-২)

‘রাতের কসম, যখন তা সরে চলে যায়, প্রভাতের কসম, যখন তা উদ্ভাসিত হয়।’ (সূরা মুদ্দাসসির: ৩৩-৩৪)

‘অতঃপর আমি কসম করছি পশ্চিম আকাশের লালিমার। আর রাতের কসম এবং রাত যা কিছুর সমাবেশ ঘটায় তার।’ (সূরা ইনশিকাক: ১৬-১৭)
‘কসম পূর্বাহ্নের, কসম রাতের, যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়।’ (সূরা দুহা: ১-২)

এভাবে আল্লাহ সময়ের কসম করেছেন বহু জায়গায়। মানুষকে বুঝাতে চেয়েছেন সময়ের মূল্য। কারণ এই সময়ই হলো মানবজীবনের সবেচয়ে বড় সম্পদ।

অপর দিকে হাদিস শরিফেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সময়ের মূল্য বিষয়ে করেছেন অনেক আলোচনা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন-‘দু’টি নেয়ামতের ব্যাপারে অনেক মানুষ প্রতারিত হয়। তা হচ্ছে- সুস্থতা ও অবসরতা।’ (সহীহ বুখারী ৬৪১২, তিরমিযি ২৩০৪)

ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন-‘কখনো মানুষ সুস্থ থাকে, কিন্তু অবসর থাকে না। ব্যস্ত থাকে জীবিকা নির্বাহে। আবার কখনো সে অবসরে থাকে, কিন্তু সুস্থ থাকে না। অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। যদি কখনো তার মাঝে উভয়টি একত্র হয়, কিন্তু আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে অলসতা তার ওপর তেড়ে বসে, তাহলে সে হয়ে যায় প্রতারিত।’ সুতরাং সময় পরম মহত্তর একটি নেয়ামত। যেটা থেকে কেবল তারাই উপকৃত হতে পারে যাদেরকে দেয়া হয়েছে অসাধারণ বোধ-বিবেচনার শক্তি। এদিকে ইঙ্গিত করে হাদিসে বলা হয়েছে- ‘অধিকাংশ লোক এ ব্যাপারে প্রতারিত-প্রবঞ্চিত।’ অতএব খুব কম লোকই এর সুফল লাভ করতে সক্ষম হয়, এবিষয়ে বেশির ভাগ মানুষই আত্মপ্রবঞ্চনায় মগ্ন। আবার পরকালেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মানুষের সময়ের ব্যাপারে। আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা, বলেন, নবীজী সা. বলেছেন-‘পাঁচটি বিষয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা না হবে কিয়মত দিবসে বান্দা তার রবের সামনে থেকে এক কদমও নাড়াতে পারবে না- তার জীবন সম্পর্কে, কি কাজে তা ব্যয় করেছে, তার যৌবনকাল সম্পর্কে কি কাজে তা কাটিয়েছে, তার সম্পদ সম্পর্কে- কোথা থেকে তা উপার্জন করেছে ও কোথায় ব্যয় করেছ, তার ইলমের ওপর কতটুকু আমল করেছে।’ (তিরমিযি ২৪১৬)

আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. বর্ণিত অন্য হাদিসে আছে, নবীজী সা. বলেছেন-‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি অবস্থার পূর্বে গনিমত মনে কর। যথা- তোমার যৌবনকে বার্ধক্যের পূর্বে, সুস্থতাকে অসুস্থতার পূর্বে, স্বচ্ছলতাকে দারিদ্রতার পূর্বে, অবসরকে ব্যস্ততার পূর্বে এবং জীবনকে মৃত্যুর পূর্বে। (মুস্তাদরাকে হাকেম, কিতাবুর রিকাক)

বিখ্যাত দার্শনিক আলেম ইমাম গাযালী রহ. সময় সম্পর্কে বলেন-‘সময়ই আপনার জীবনকাল। আর জীবনকাল হচ্ছে আপনার মূলধন। এতেই আপনার ব্যবসা। এর মাধ্যমেই আপনাকে পৌঁছতে হবে আল্লাহর কাছে, চিরন্তন মনজিলে। সুতরাং আপনার প্রতিটি নিঃশ্বাসই মহামূল্যবান। এর কোন তুলনা নেই । ফুরিয়ে গেলে তা আর কখনো ফিরে আসবে না। তাই আপনি ওই বোকার মতো আচরণ করবেন না।’ (বিদায়াতুল হিদায়া : ১২০)

সময়ের সংরক্ষণ, তা যথাযথ কাজে লাগানোর ব্যাপারে পূর্বসূরী মনীষীদের অদম্য আগ্রহ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। উদ্দীপ্ত করে সময়ের সঠিক ব্যবহারে। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন-‘আমি এতোটা পরিতাপে কখনো ভুগিনি, যতোটা পরিতাপ হয়- এমন দিনের জন্য, যে দিনের সূর্য ডুবে গেলো, আর আমার দুনিয়ার হায়াত কমে গেলো, অথচ সেদিনে আমার কোন ভালো কাজ বৃদ্ধি পেলো না।’

বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী রহ. বলতেন- ‘হে আদম সন্তান! তুমি ক’টি দিনের সমষ্টি মাত্র। সুতরাং যখন একটি দিন অতিবাহিত হলো তখন তোমার জীবনের কিছু অংশ হারিয়ে গেলো।’ (আল হিলইয়া: ২/১৪৮)

জনৈক কবি বলেন-‘প্রতিদিন আমার কিছু অংশ মারা যায়, আমার জীবন তো কেবল কিছু নিঃশ্বাসের সমষ্টি।’ (কাসরুল আমাল: ১৩৫)

মুসলিম মনীষীদের সময়ের মূল্যায়ন সম্পর্কে বলতে গেলে বৃহত কলেবরের গ্রন্থেও তা আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়, তাঁরাই প্রকৃত পক্ষে সময়কে মূল্যায়ন করেছেন, তাই হাজার বছর পরও জাতি তাঁদেরকে স্মরণ করছে পরম শ্রদ্ধার সাথে। তাঁদের নাম শুনলে এখনো মানুষ শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়। মোটকথা, ইসলামে সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ হয়তো তার পরকালীন সমৃদ্ধির জন্য ভালো কাজে সময় ব্যয় করবে, অথবা তার জাগতিক প্রয়োজনে বৈধ কাজে সময় পার করবে। এর বাইরে অলস বসে থাকাকে ইসলাম চরম ঘৃণা করেছে।

কুরআন পড়ুন, কুরআন বুঝুন:

আমরা প্রাত্যহিক কাজের ব্যস্ততায় অনেক সময় নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি না। অথবা করলেও পরিমাণে তা খুব বেশি হয় না। আবার অনেকে কুরআন তিলাওয়াত নিয়মিত করলেও কুরআন বুঝার চেষ্টা ততটা করি না। অথচ কুআন তিলাওয়াত যেমন একটি ইবাদত, তেমনি আরেকটি ইবাদত হলো কুরআনের মর্ম বুঝে অধ্যয়ন করা। মহান আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন যেন তাঁর বান্দারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করে, কুরআনের অর্থ ও ভাব অনুধাবন করে এবং কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করে। কুরআনে উল্লেখিত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিটি মানুষই কুরআন থেকে ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কিত বিষয়াবলীর সঠিক দিক-নির্দেশনা যেন গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে কুরআন তিলাওয়াত এমনই একটি আমল, যা ব্যক্তিকে কুরআন অনুযায়ী জীবন-যাপন এবং পরকালমুখী করে দেয়। পার্থিব জীবনের সফলতার পথ দেখায় এবং মহান আল্লাহর বিধিবিধান খুব ভালোভাবে বুঝার সুযোগ করে দেয়। এজন্যই কুরআন তিলাওয়াতের আদেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ নিজেই। তিনি বলেন-‘(হে নবী!) ওহীর মাধ্যমে তোমার প্রতি যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তা তিলাওয়াত কর।’ (সূরা আনকাবূত : ৪৫)

কুরআন তিলাওয়াতকারীর লাভ ও সওয়াবকে আল্লাহ এমন ব্যবসার সাথে তুলনা করেছেন, যে ব্যবসা কখনো ক্ষতিগ্রস্থ হয় না-‘যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে। তারা এমন ব্যবসায়ের আশাবাদী, যাতে কখনও লোকসান হয় না।’ (সূরা ফাতির : ২৯)

এ আয়াতদ্বয় নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে মানুষকে। কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত উল্লেখ করতে গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. এর সূত্রে নবীজী সা. বলেছেন- ‘যে কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে তার একটি নেকি, আর একটি নেকিকে দশগুণে বৃদ্ধি করা হবে।’ (তিরমিযি ২৯১০)

সুতরাং কেউ কুরআনের একটি অক্ষর পড়লে তার আমলনামায় দশটি নেকি যুক্ত হবে।

অন্য হাদিসে আবদুল্লাহ ইবনু উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সা. বলেছেন-‘ (কিয়ামতের দিন) কুরআনের তিলাওয়াতকারী বা হাফেজকে বলা হবে-তিলাওয়াত করতে থাক এবং উপরে উঠতে থাক। ধীরে ধীরে তিলাওয়াত কর, যেভাবে ধীরে ধীরে দুনিয়াতে তিলাওয়াত করতে। তোমার অবস্থান হবে সর্বশেষ আয়াতের স্থলে যা তুমি তিলাওয়াত করতে।’ (সুনানে আবু দাউদ ১৪৬৪, তিরমিযী ২৯১৪)

তাই আমরা এই অবসরে পাক কালমের তিলাওয়াতের মাধ্যমে আমলনামাকে সমৃদ্ধ করতে পারি।

কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সব বিধিবিধান বাস্তবায়ন এবং এ সকল বিষয়ে সুগভীর চিন্তা-গবেষণা করা। দুনিয়ার জীবন-যাপন এবং পরকালের সফলতার রহস্যাবলী অনুসন্ধান এবং অনুধাবন করা। আল্লাহর বিধিবিধান অবহিত হয়ে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা এবং কুরআনে উল্লেখিত পূর্ববর্তী সকল ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। অতএব মহান আল্লাহর এই পবিত্র গ্রন্থকে আসুন এই মহাবিপদের সময় বেশি বেশি তিলাওয়াত করি ও অনুধানের চেষ্টা করি।

নফল নামায, দুআ ও যিকিরের বিপুল সুযোগ:

বাড়িতে নফল ও সুন্নাত নামায পড়া নবীজী সা.এর নিয়মিত অভ্যাস ছিল। হাদিসে বাড়িকে করস্থান বানাতে নিষেধ করেছেন তিনি-এর মর্ম কথা হলো, যে বাড়িতে নামায পড়া হয় না তা কবস্থানের সমতুল্য। অতএব এই অবসরে আমরা বাড়িতে নফল ও সুন্নাত নামাযগুলো পড়বো। বিশেষ করে তাহাজ্জুদের বিষয়ে প্রত্যেকেই যতœবান হবো। কারণ, রাতের এক তৃতীয়াংশ পার হয়ে যাবার পর আল্লাহ মানুষকে ডাকতে থাকেন- ‘কে আছো ক্ষমা প্রার্থনাকারী (ক্ষমা চাও) আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। কে আছো জীবিকার সংকটে (আমার কাছে প্রার্থনা কর) আমি তার জীবিকার প্রশস্ততা দিব।’ এভাবে নানা বিষয়ের প্রয়োজন ধরে আল্লাহ মানুষকে ডাকতে থাকেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বিস্তারিত আলোচনা আছে এবিষয়ে।

পাঠক, বিপদ আমাদের। প্রয়োজনও আমাদের, অথচ আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করার জন্য, প্রয়োজন মিটানোর জন্য এভাবে ডাকতে থাকেন সকাল পর্যন্ত। তাই কোন সচেতন মানুষের এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিৎ নয়। সাথে সাথে অন্যান্য যে নফল আছে, ইশরাক, আওয়াবীন এগুলোর ব্যাপারেও আমরা মনোযোগী হবো। তাছাড়া হাদিসে বর্ণিত যে দুআ রয়েছে আমরা সেগুলো বেশি বেশি পড়ব। বিশেষ করে দুরুদ শরিফ, ইস্তিগফার ও বিপদের দুআগুলো। এগুলো পড়তে অজু আবশ্যক না, তাই শুয়ে বসে হাঁটতে চলতে আমরা এ দুআ দুরুদ ও ইস্তিগফারের আমল করতে পারি।

সন্তানদের দেখাশোনার বড় একটি মুহূর্ত:

ব্যস্ত বাবারা অনেক সময় সন্তানকে লম্বা সময় দিতে পারেন না। তাদের পড়াশোনা ও নৈতিকতার উন্নয়নের বিষয়েও পিতারা অনেক সময় থাকেন সম্পূর্ণ অসচেতন। অথবা সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে ইচ্ছে থাকলেও পারেন না যথাযথ তদারকি করতে। তাই তাদের জন্য এ সময়টি বড় লভজনক। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: ‘বাবা যখন তার সন্তানের দিকে তাকায় এবং খুশি অনুভব করে তখন সে একজন গোলাম আযাদ করার পুণ্য লাভ করে। প্রশ্ন কার হলো – হে আল্লাহর রাসূল! যদি কেউ তিনশ’ ষাট বার তাকায়? বললেন: আল্লাহু আকবার – আল্লাহর ভাÐার এরচেয়েও বড়।’ (তাবরানী আওসাত ৮৬৪৬, তাবরানী কাবীর ১১৬০৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ১৩৪৮৭, শুয়াবুল ঈমান ৭৮৫৭, মুসনাদে দাইলামী ১২৭২, কানযুল উম্মাল ৪৫৪৬১, ৪৫৫০৭)

নবীজী সা. সন্তানের দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকালে এই সওয়াবের ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন হাদিসে সন্তান লালনের মাধ্যমে মহাপুণ্য অর্জনের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন মানুষকে।

মনে রাখতে হবে দুনিয়াতে সন্তান যেমন পিতা-মাতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তেমনি আখেরাতেও মুক্তির উপায়। মৃত ব্যক্তি কবরে সমুদ্রে ডুবন্ত ব্যক্তির মত মহাবিপদে থাকে। বিশেষভাবে তখন সন্তানের দুআ তার উপকারে আসে। কবরে থেকেও সে সন্তানের দুআর মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকে। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন, মানুষ মারা গেলে তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় তবে তিনটি আমলের ধারা অব্যাহত থাকে, ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. উপকারী বিদ্যা, তার মৃত্যুর পরও যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হতে থাকে, ৩. নেককার সন্তান, যে পিতা-মাতার জন্য দুআ করে। (সহীহ মুসলিম ১৬৩১, তিরমিযী ১৩৭৬, নাসায়ী ৩৬৫১, দারামী ৫৭৮, আহমাদ ৮৮৪৪)

আবু হুরায়রা রা. থেকে আরো বর্ণিত, নবীজী বলেছেন: জান্নাতে আল্লাহ তা’য়ালা নেককার বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, তখন সে জিজ্ঞেস করে- হে আমার প্রতিপালক এটা কোত্থেকে আসল? তখন বলা হবে ‘তোমার সন্তান কতৃক তোমার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমে। ( ইবনু মাজাহ : ৩৬৬০, আহমাদ :৮৭৫৮, ১০৬১০)

এ ছাড়াও সন্তানকে যত ভালো কাজ পিতা শিখিয়েছেন, মৃত্যুর পরও তার সাওয়াব তিনি পেতে থাকবেন। আনাস রা. বলেন, নবীজী সা. বলেছেন, ভালো কাজের পথ দেখানো তা সম্পাদন করার মতই। (তিরমিযি: ২৬৭০)

প্রিয় পাঠক, এই হল সন্তান। আপনার বড় সম্পদ। দুনিয়াতে ও আখেরাতে। তাই আসুন, সন্তানকে মানুষের মত মানুষ বানিয়ে উভয় জগতে সুখ-সমৃদ্ধি, মুক্তি ও সফলতা অর্জন করি। বিশেষ করে এই বিস্তর অবসরে সন্তানের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি।

গঠনমূলক বই পড়ুন:

কর্মজীবি মানুষের ভেতরে অনেকেই আছেন যারা সময় বাঁচিয়ে বই পড়েন। আবার অনেকের ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে বই পড়া হয়ে ওঠে না। অথচ করোনায় এই দীর্ঘ কর্মবিরতিতে আমরা গঠনমূলক বই পড়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারি। জানার পরিধি করতে পারি বিস্তৃত। এক্ষেত্রে মানসম্মত ধর্মীয় বই দিয়েই আমরা পড়ার কাজটি শুরু করতে পারি। তাতে জানাও যেমন হবে, আবার হৃদয়েরও পরিবর্তন আসবে অনেক।

তাই আসুন, এই বিস্তৃত সময়কে কাজে লাগাই। শুধু শুয়ে বসে না কাটাই। মনে রাখবেন, আপনার সময় আপনার জীবনের একটি অংশ। সময়কে একটি মোমবাতির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। মোমবাতি জ্বালিয়ে আপনি কাজ করলেও তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জ্বলে ফুরিয়ে যাবে, আবার কাজ না করে শুধু শুধু জ্বালিয়ে রাখলেও তা ফুরাবে। তাই আমাদের জীবনকে মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যয়ান করতে হবে আমাদের সময়কে। তা কোন বিপর্যয়কালীন মুহূর্তে হলেও। আর করোনার এই মহামারীতে আল্লাহর করুণা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। তাই আমাদের এই কর্মবিরতি যেন হয় স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের সুবর্ণ সুযোগ।

লেখক, ইমাম, বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদ, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মুহাদ্দিস, বলিদাপাড়া মাদরাসা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here