বিশেষ প্রতিবেদকঃ

কৃষি কাজ করেই ছোট ছেলের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচ চালান তিনি। এ বছর তিন বিঘা জমিতে আমন মৌসুমের ধান চাষ করেন। জমিতে ধান লাগানো ও সার বাবদ খরচ করেন প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এ পুরো টাকায় গেছে পানিতে। সেচের পানির অভাবে কাঁচা ধান কেটে গরুর খাদ্য বানিয়েছেন। একমাত্র সহায়-সম্বল হারিয়ে এখন হতাশায় দিন কাঁটছে। কিভাবে ছেলের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাবেন? কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ২নং জামাল ইউনিয়নের হরদেবপুর গ্রামের ধানচাষী উদয় শংকর বিশ্বাস।

হরদেবপুর গ্রামের উদয় শংকরের মতো প্রায় ১০০ কৃষকের পরিবার এখন চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। সবার একই চিন্তা, কিভাবে সংসারের খরচ চালাবেন।

হরদেবপুর গ্রামের কৃষক উদয় শংকর বিশ্বাস। ৩ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। সব ধান নষ্ট হয়ে দিশেহারা তিনি। ছবিঃ শাহরিয়ার আলম সোহাগ।

সরেজমিনে হরদেবপুর গ্রামে গিয়ে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ক্ষতিগ্রস্থ ৬ জন কৃষকের সাথে। সবার মধ্যেই হতাশা লক্ষ্য করা গেছে। যেন ওই তিন প্রতিষ্ঠান সেচের পাম্পগুলো মেরামত করে। আমরা এই ধান চাষের উপরই নির্ভরশীল। মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, পানির অভাবে ধান গাছ মরে যাচ্ছে, অনেকে কাঁচা ধান কেটে গরুর খাদ্য বানাচ্ছেন। আবার অনেক কৃষক অন্য ফসলের আবাদ শুরু করেছেন।

কৃষকরা জানান, মাঠের মধ্যে বিদ্যুতের লাইন না থাকায় বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করা হয় না। ২০১৫ সালের পূর্বে এই গ্রামের কৃষকরা স্যালো মেশিনের মাধ্যমে সেচের পানি দিয়ে জমিতে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করতো। এরপর এই বছরের জানুয়ারি মাসে গ্রামের কৃষকদের সাথে আলোচনা করে সোলার পাম্প চালিত ডিপ-টিউবয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেয় এইড ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও। এনজিওটির পক্ষ থেকে কৃষকদের জানানো হয়, অল্প খরচে তারা জমিতে সেচ দিতে পারবেন। বছরের সব সময় পানি পাওয়া যাবে, বিদ্যুতের জন্য অপেক্ষা করা লাগবে না এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়। এরপর কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে সোলার পাম্প চালিত ডিপ-টিউবয়েল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কৃষকরাও সোলার প্যানেল স্থাপনের জমি দেন।

পানির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে ৫’শ বিঘা জমির ধান। কাঁচা ধান কেটে গরুর খাদ্য বানানো হচ্ছে। ছবিঃ শাহরিয়ার আলম সোহাগ।

ইনপ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইডকল), এইড ফাউন্ডেশন ও এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে ৫টি পাম্প স্থাপন করা হয়। এসময় গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি হয়, বোরো মৌসুমে বিঘা প্রতি ৩ হাজার ৬’শ টাকা এইড ফাউন্ডেশন কে পরিশোধ করতে হবে। অন্য মৌসুমে আরো কম লাগবে। তখন স্যালো মেশিন দিয়ে বোরো মৌসুমে বিঘা প্রতি ৬ হাজার টাকা খরচ হতো। এভাবে চুক্তির মাধ্যমে ২০১৬ সালের বোরো মৌসুম থেকে পানি ক্রয় করতে থাকেন কৃষকরা। প্রথম বছর পাম্পগুলো ভালো চলার পর ২০১৭ সাল থেকে একটি একটি করে ৫টি পাম্পই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ওই তিন প্রতিষ্ঠান মেরামতের উদ্যোগ নেয় না। বর্তমানে একটি পাম্প সচল করা হলেও বাকি ৪টি পাম্প নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। হরদেবপুর গ্রামের প্রায় ৫’শ বিঘা জমিতে অন্যান্য ফসলের চাষ থেকে ফিরে এসে ধানের চাষ করেন। কিন্তু পানির অভাবে সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে কাঁচা ধান কেটে গরুর খাদ্য বানাচ্ছেন তারা।

কৃষক রফিকুল ইসলাম। ৪ বিঘা জমিতে আমন মৌসুমে ধান চাষ করেছিলেন। সব ধান পানির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। কিভাবে সংসারের চালাবেন সেই চিন্তায় করছেন। ছবিঃ শাহরিয়ার আলম সোহাগ।

কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই পাম্পগুলো স্থাপন করা হয়েছে। মেরামতের জন্য এইড ফাউন্ডেশনকে বারবার জানানো হলেও তারা এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডকে দোষারোপ করছে। এইড ফাউন্ডেশন বলে, মেরামতের দায়িত্ব তাদের। আবার এনার্জিপ্যাককে বললে তারা এইড ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে বিল পরিশোধ না করার অভিযোগ করেন। বিল না পেলে তারা আর কিছু করবেন না বলেও জানিয়ে দেন। পল্লী বিদ্যুৎ অফিসসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিষয়টি জানানো হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে এইড ফাউন্ডেশনের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা উপ-পরিচালক মোঃ আশাবুল হক জানান, ২০১৭ সাল থেকে এই পাম্পগুলো নষ্ট হতে শুরু করে। জেলার বিভিন্ন স্থানে ১২ টি পাম্প নষ্ট হয়। যার মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলার হরদেবপুর গ্রামের ৫ টি পাম্প নষ্ট হয়। ইতিমধ্যে অন্য কোম্পানী থেকে মালামাল ক্রয় করে যে পাম্পগুলো তারা স্থাপন করেছিলেন সেগুলো সচল করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু হরদেবপুর গ্রামে এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এর স্থাপন করা ৫ টি ভালো করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশ্য, ইতিমধ্যে তারা একটি সচল করে দিয়েছেন, বাকিগুলো করেননি।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার হরদেবপুর গ্রামের মাঠে সোলার পাম্প স্থাপন করা হয়। স্থাপনের এক বছরের মধ্যে সবগুলো নষ্ট হয়েছে। ছবিঃ শাহরিয়ার আলম সোহাগ

তিনি আরো বলেন, ইডকল থেকে অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে তারা এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এর বিল পরিশোধ করবেন। যে কারনে তাদের দেড় কোটি টাকার মতো বকেয়া রয়েছে।

এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড এর সিইও মোঃ আক্তারুজ্জামান জানান, এইড ফাউন্ডেশনের কাছে তারা এখনও ২ কোটির অধিক টাকা পাবেন। এই টাকা পরিশোধ না করলে তারা নতুন করে প্রকল্পে ব্যয় করতে পারছেন না। তারপরও কৃষকের কথা চিন্তা করে তারা একটি সচল করে দিয়েছেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here