যশোরঃ
শিশির ঘোষ। পুলিশের খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। পুলিশের দাবি- শহরের ষষ্ঠীতলাপাড়ায় তাকে ঘিরেই সক্রিয় ছিল উঠতি বয়সের কিশোর অপরাধী চক্র। সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ৩০ বছর বয়সী শিশির। তার মৃত্যুর পরও কামেনি এই গ্রুপের তৎপরতা। শিশিরের মতোই শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ‘বড় ভাইদের’ ছত্রছায়ায় ১৫-২০টি ভয়ংকর কিশোর গ্যাং তৎপর রয়েছে।
তারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক, সন্ত্রাস ও যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তুচ্ছ ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ত করা ছাড়াও এলাকার ‘বড় ভাইদের’ দিকনির্দেশনায় তারা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের কাছে থাকে অস্ত্র, গুলি, বোমা ও ছুরি। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটছে।
যশোরের মতো সারা দেশেই কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের দিকে তাকালেই তার পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। এখন দেশের ৪৫টি জেলার অন্তত ৩৫০ শিশু-কিশোর অপরাধীকে এই কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। প্রতিমাসে এই কেন্দ্রে ১৩০-১৪০ জন কিশোর অপরাধী আসছে। জামিন নিয়ে প্রতিমাসে বেরিয়ে যাচ্ছে ১১০-১২০ জন। এখানে আসা শিশু-কিশোরদের অধিকাংশই খুন, ধর্ষণ ও মাদক মামলার আসামি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কথা হয় যশোরের পুলিশ সুপার মঈনুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে পুলিশ কিশোরদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় অভিযান চালাচ্ছে। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন অপরাধীকে ধরা হয়েছে। আটক নিরপরাধ কিশোরদের তাদের অভিভাবকদের হেফাজতে দিয়েছি। বাকি অপরাধীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, নিয়মিত টহল ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো গ্যাংয়ের নামে কোনো ধরনের অপরাধ হচ্ছে কি না, সেটি আমরা খুঁজছি। সুনির্দিষ্টভাবে গ্যাং পাইনি। তবে বিক্ষিপ্তভাবে আছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমাদের সহযোগিতা করুন। আমরা কঠোর নজরদারি করছি। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন জিরো টলারেন্স।
৬ জুন যশোর শহরের রেলস্টেশন এলাকায় স্কুলছাত্র আবদুল্লাহ খানকে (১৩) ছুরিকাঘাতে হত্যা করে উঠতি বয়সী কিশোর অপরাধীরা। শহরের আশ্রম রোডের শাহিনের ছেলে তাওহিদ, একই এলাকার রাশিদুলের বাড়ির ভাড়াটিয়া আবদুল গফ্ফারের ছেলে আশিকুল ইসলাম আশিক, টিবি ক্লিনিক এলাকার সুমনের বাড়ির ভাড়াটিয়া মৃত শেখ জাহিদ হাসানের ছেলে আকাশ, রেলরোডের রুহুল হাজির বাড়ির ভাড়াটিয়া সেলিম হোসেনের ছেলে মাসুদ রানা ও চাঁচড়া রায়পাড়ার বিল্লালের বাড়ির ভাড়াটিয়া রাহাতের ছেলে নয়ন মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে।
তারা আদালতে ১৬৪ ধারার দেয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তারা আবদুল্লাহকে খুন করেছে বলে জানিয়েছে।
প্রেম সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে ২৪ জুলাই শহরতলীর ভাতুড়িয়া এলাকায় ইমরোজ হোসেন (৩২) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খুনের সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ আলী, চাঁচড়া ডালমিল এলাকার আজিজুর রহমানের ছেলে রিংকু, চাঁচড়া মধ্যপাড়ার মৃত ভগোর ছেলে স্বাধীন ও ভাতুড়িয়া দাইপাড়ার মোহাম্মদ শাহাজাহানের ছেলে আবদুর রহিম। এদের সবার বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। এক প্রেমিক জুটিকে নিয়ে বিরোধের জেরে ইমরোজকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন।
১৩ জুন শহরের সন্ন্যাসী দীঘিরপাড় এলাকায় ছুরিকাঘাতে ফেরদৌস হোসেন (২০) নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চাঁচড়া রায়পাড়ার মেসিয়ার খোকনের ছেলে সাব্বির হোসেন, শংকরপুর এলাকার আকাশ হোসেন, সিপন হোসেন, সাকিব হোসেন, রাজা, জাহাঙ্গীর হোসেন ও ফয়েজ হোসেন ডেকে নিয়ে ফেরদৌসকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
১৮ জুন যশোর শহরের শংকরপুর বাস টার্মিনাল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে সানি (২৮) নামে এক যুবক নিহত হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে শহরের শংকরপুর গোলপাতা মসজিদ এলাকার ফারুক হোসেনের ছেলে সাহেদ হোসেন ওরফে হিটার নয়ন, একই এলাকার দেলোয়ার হোসেন দুলালের ছেলে শোভন, তকব্বর শেখের ছেলে মতিয়ার রহমান ওরফে সিডিআই মতি, ওয়াজেদ আলী দফাদারের ছেলে হাফিজ, শাহাজান মিস্ত্রির ছেলে শান্ত, আলমগীর শেখের ছেলে ভুট্টো, শংকরপুর মেডিকেল কলেজপাড়ার মিন্টুর ছেলে টুটুল এবং বেজপাড়া কবরস্থান রোডের জামাল হোসেনের ছেলে ভূষি সুমন।
১৩ মার্চ রাতে শহরের মিশনপাড়া বিমান অফিস মোড়ে নয়ন চৌধুরী সাজু নামে এক যুবককে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছালছাবিল আহমেদ জিসান, হামিদপুরের খায়রুলের ছেলে পাভেল, মিশনপাড়ার ছোট খোকনের ছেলে রাব্বি, একই এলাকার খোকনের ছেলে রনিসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪-৫ জনের নামে মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ছালছাবিল আহমেদ জিসানকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ।
সচেতন নাগরিক কমিটি যশোর শাখার সভাপতি সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক সুকুমার দাস বলেন, আগে পাড়া-মহল্লায় সৃজনশীল চর্চা হতো। ক্লাবভিত্তিক নানা কার্যক্রম ছাড়াও সুস্থধারার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত। ছোট, বড় সবারই খেলাধুলা, নাচগানের আয়োজন করা হতো।
তাদের সবার সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এখন সেই চর্চা নেই। অভিভাবকরা মনে করে সন্তান ‘এ’ প্লাস পেলেই সফল। ‘এ’ প্লাসের পেছনে ছুটতে গিয়ে সৃজনশীল চর্চায় আগ্রহ নেই কিশোরদের। সংস্কৃতি, ক্রীড়াচর্চাবিমুখ শিশু-কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের ফেরাতে হবে। বিকালটা ফ্রি করে দিতে হবে সৃজনশীল চর্চার জন্য।
শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে কথা হয় যশোর কিশোর (বর্তমানে শিশু) উন্নয়ন কেন্দ্রের সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আগে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল। বর্তমানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধের মূলে রয়েছে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। যেমন আগে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা, এলাকার বড়ভাই ও মুরুব্বিদের একটা আদর্শ ছিল। তাদের প্রতি সবার সম্মান ছিল। এলাকার কোনো ছেলে একটা সিগারেট খেলেও গুরুজনকে দেখলে ভয় পেত। বর্তমানে সেটি আর নেই। নষ্ট হয়ে গেছে। সামাজিকভাবেই বিশৃঙ্খলা চলছে।
একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা শিথিল হয়ে গেছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন, খেলাধুলা আগের মতো নেই। আবার মা-বাবারা দাবি করছে সচেতন। মনে করছেন সন্তানকে ভালো স্কুলে কিংবা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ। সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয় না। নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির কুপ্রভাবেও কিশোরদের মধ্যে একটি হিরোইজম কাজ করে। এতে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সী ও কিশোর অপরাধীর গ্রুপের তৎপরতা রয়েছে। তাদের ওপর আমরা নজরদারি করছি। নিয়মিত পুলিশি টহল অব্যাহত আছে। অপরাধ দমনে পুলিশ সতর্ক আছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। শহরের বেশির ভাগ অভিভাবক সন্তানের ব্যাপারে উদাসীন। এজন্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।