ঝিনাইদহঃ

যশোর শিক্ষা বোর্ডের জাল অনুমতিপত্র তৈরি করে ৭ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ৭০ লাখ টাকার বেশি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

প্রাথমিক তদন্তে ঘটনাটি প্রমাণিত হয়েছে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটেছে। খবর নিশ্চিত করেছেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিশ্বাস শাহিন আহম্মেদ ও ঝিনাইদহ জেলা শিক্ষা অফিসার (মাধ্যমিক) সুশান্ত কুমার দেব। জড়িতরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যুগান্তরের নিবিড় অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে চাঞ্চল্যকর সেই খবর।

ইতিমধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সংশ্লিষ্ট পোড়াহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরণকে বিদ্যালয়ের ম্যানিজিং কমিটির সভাপতির পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ জারি করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. কামরুল হাসান স্বাক্ষরিত ১৩ জুনের এক চিঠিতে তাকে অপসারণ করার আদেশ দেয়া হয়। পৃথক আরেক চিঠিতে একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামানের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ বন্ধ করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে বিদ্যালয়টির বরখাস্ত হওয়া প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামান জানান, ২০০৩ সালের ১৮ আগস্ট এবং ২০০২ সালের ১২ নভেম্বর তারিখে যশোর শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শকের জাল স্বাক্ষরে শ্রেণি শাখা খোলার পৃথক দুটি চিঠি তৈরি করা হয়। ওই জালপত্রের ৮ম শ্রেণি ’গ’ ও নবম শ্রেণি ’খ’ এবং ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও ৭ম, ৮ম ও ১০ম শ্রেণিতে শাখার খোলার অনুমতি দেখানো হয়।

পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়টির সভাপতি হন ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সংশ্লিষ্ট পোড়াহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরণ। প্রধান শিক্ষক জানান, ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যায়যায়দিন এবং স্থানীয় দৈনিক নবচিত্র পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মৃত ও শূন্য পদ দেখিয়ে ৩ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। একই বছরের ২৮ মে ৩ জন এবং ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়।

এরা হলেন মো. হাসানুজ্জামান, মাসুদুর রহমান, রূপালী খাতুন, জাকির হোসেন, শ্যামলী খাতুন, বাবুল আক্তার ও রাসেল হোসেন। এদের মধ্যে রাসেল হোসেন চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। বাকিরা নিয়োগ লাভের পর থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন-ভাতার সরকারি অংশ তুলছেন, যা ৭০ লাখ টাকার বেশি হবে।

এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামান। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়ে বিদ্যালয়টির সভাপতি, সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার (বর্তমানে বরিশাল বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক) মো. মকছেদুল ইসলাম, তার গাড়ির ড্রাইভার সেলিম ও শিক্ষক নেতা মহিউদ্দিন জাল কাগজপত্র তৈরি করেন এবং ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত তারা। শিক্ষক নেতা মহিউদ্দিন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

তিনি পাল্টা প্রধান শিক্ষককে ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন। অবশ্য বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটি সভাপতির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে আগেই প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামানকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত কাগজপত্র মোতাবেক (জাল অনুমতিপত্রের সূত্র ধরে) ৩ ধাপে নিয়োগ দেয়া হয় ৭ জন সহকারী শিক্ষককে। গঠিত নিয়োগ বোর্ডে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ছিলেন ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সুনীল কুমার ও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আফরোজা হক এবং স্থানীয় শিক্ষক নেতা মহিউদ্দিনসহ কয়েকজন। নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার দুই মাসের মধ্যে নবনিযুক্ত শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হন এবং নিয়মিত বেতন ভাতার সরকারি অংশ তুলে আসছেন।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। ২০১৮ সালের শেষদিকে বিধি হল বাম। প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামান ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রধান শিক্ষককে নেশাখোর, দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে দুই দফায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধান শিক্ষক আসল খবর ফাঁস করে দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ দাখিল করেন তিনি। অভিযোগে ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ তিনি সভাপতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। সূত্র মতে, দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকা থেকে স্থানীয় সরকার শাখা জেলা প্রশাসক ঝিনাইদহের কার্যালয়ের উপপরিচালককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়।

পত্র চালাচালির এক পর্যায়ে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড যশোরের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিশ্বাস শাহিন আহম্মেদ স্বাক্ষরিত এক পত্রে ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এবং ২০০৩ সালের ১৮ আগস্ট ইস্যু করা স্মারকে শাখা খোলার অনুমতিপত্র পাঠানো হয়নি বলে জানিয়ে দেন। এরপর থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে।

জেলা প্রশাসক ঝিনাইদহের কার্যালয়ের উপপরিচালক (উপসচিব, বর্তমানে পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অধীন খুলনা বিভাগীয় পরিচালক) সাইফুর রহমান খান তদন্ত প্রতিবদন প্রস্তুত করেন। ওই প্রতিবেদনে মধুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শহিদুল ইসলাম হিরণ ও প্রধান শিক্ষক মো. বদিউজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে তাদের বেতন-ভাতার ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম গ্রহণ করে অবহিত করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতে, চেয়ারম্যান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড যশোর সংশ্লিষ্টদের বরাবর চিঠি পাঠান। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। পরিবর্তন হয়নি সভাপতি। বৈধভাবে বেতন তুলছেন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। অনুসন্ধানকালে বিদ্যালয়টির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সালেহা বেগম ফোনে রাগত কণ্ঠে এমন তথ্য জানালেন।

তিনি জানান, আমি ব্যস্ত আছি, কথা বলতে পারব না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জাল অনুমতিপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ করা ৭ জন সহকারী শিক্ষক সব শেষ গত জুন মাসের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ তুলেছেন।

এ বিষয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার (মাধ্যমিক) সুশান্ত কুমার দেব বলেছেন, জাল অনুমতিপত্রের নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা আজও কিভাবে বেতন ভাতার সরকারি অংশ তুলছেন তা বোধগম্য নয়। বিধি মোতাবেক ওই ৭ জন শিক্ষকের বেতন-ভাতা হওয়ার কথা নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। অভিযুক্ত বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শহিদুল ইসলাম হিরণ বর্তমানে মক্কায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। সে কারণে তার বক্তব্য গ্রহণ করা যায়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here