ঢাকাঃ

যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও  সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাত ধরে ২০১৬ সালে ঢাকায় শুরু হয় ক্যাসিনো কালচার।

প্রথমে মতিঝিল পাড়ার স্পোর্টস ক্লাবগুলোকে টার্গেট করেন সম্রাট-খালেদ। সেসব ক্লাবগুলোতে আগে থেকেই হাউজির (জুয়া) আসর বসতো, সেগুলোকেই ক্যাসিনোতে পরিণত করেন যুবলীগের এই দুই নেতা।

গ্রেফতার হওয়ার পর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে যুবলীগ নেতা খালেদ এসব তথ্য র‌্যাবকে জানিয়েছেন বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

খালেদ জানান, ঢাকায় ক্যাসিনো কালচারের শুরু সম্রাটের হাত ধরে। সম্রাট নিজে সরাসরিভাবে এসব ব্যবসা পরিচালনা করতেন না। তার হয়ে যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা এসব ব্যবসার দেখাশোনা করতেন।

নেপাল থেকে ক্যাসিনো এক্সপার্ট আনেন সম্রাট:

জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ বলেছেন, সম্রাট গত কয়েক বছরে ক্যাসিনো কারবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে নেপাল থেকে এক্সপার্ট এনেছিলেন। তাদের মধ্যে ১১ জন ঢাকার ক্যাসিনো কারবার নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতা করতেন। সম্রাট সিঙ্গাপুর গিয়ে ক্যাসিনোয় জুয়া খেলায় অংশ নিতেন। সে সময় তিনি দেশের অনেক টাকা পাচার করেছেন।

সম্রাটের হয়ে যারা চালাতেন ক্যাসিনো:

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্রাটের হয়ে ফকিরাপুলের ইয়ংমেন্স ক্লাবের ক্যাসিনোর দেখাশোনা করতেন খালেদ মাহমুদ নিজে। এছাড়া আরামবাগ, দিলকুশা ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ। তিনি কমপক্ষে পাঁচটি ক্লাবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

আর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালান সম্রাটের আরেক বিশ্বস্ত সহযোগী রশিদুল হক। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা আবু কায়সার এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট।

জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাটের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর দক্ষিণের যুবলীগ সহসভাপতি আরমান, সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদ, সহসভাপতি মুরসালিন, মনির হোসেন, মনা, রানা, শফি মনির হোসেনসহ আরো অনেকের নাম বলেছেন খালেদ। এরা সম্রাটের হয়ে ক্যাসিনো কারবারসহ টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন।

এছাড়াও ক্যাসিনো পরিচালনায় সাহায্য করা পুলিশের বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার নাম বলেছেন খালেদ।

ক্যাসিনোর বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় অবৈধ জুয়ার আড্ডা বা কোনো ধরনের ক্যাসিনো পরিচালনা করতে দেয়া হবে না। এসবের নেপথ্যে যত প্রভাবশালীই জড়িত থাকুক না কেন, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কঠোর হবে।

ঢাকায় ক্যাসিনোগুলো চলার সময় পুলিশের কোনো সহযোগিতা ছিল কি না তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান কমিশনার।

নিজ কার্যালয়ে পাহারায় সম্রাট:

ক্যাসিনো নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হওয়ার পর থেকে কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলের সামনে ভূঁইয়া ম্যানশনে নিজ কার্যালয়ে পাহারায় রয়েছেন যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি সম্রাট। তার পাহারায় রয়েছে কয়েকশ নেতাকর্মী।

রাত যত গভীর হয়, সম্রাটের অফিসে কর্মীদের আনাগোনা তত বাড়তে থাকে। গত তিন দিন ধরে এসব কর্মীরাই সম্রাটকে আগলে রেখেছে। খালেদকে গ্রেফতার ও ক্যাসিনো বাণিজ্যে সম্রাটের নাম আসার পর থেকে গত তিনদিন ধরে কার্যালয়েই বসে আছেন এই যুব নেতা।

ক্যাসিনোর টাকা পেত শীর্ষ সন্ত্রাসীরাও:

ক্যাসিনোর টাকা দুইজন শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছেও যেত বলে জানিয়েছেন খালেদ। তিনি জানান, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির সন্ত্রাসী নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তার ও সম্রাটের একসময় সুসম্পর্ক ছিল। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোর টাকা ওমানের মাসকটে থাকা সন্ত্রাসী নাদিমের কাছে পাঠাতেন তারা। সেখান থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানও ভাগ পেতেন। জিসান বর্তমানে ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাইয়ে বাস করছেন।

জিসানকে হাত করেন শামীম:

খালেদকে গ্রেফতারের পর শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর নিকেতনে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর চেক এবং মাদকসহ গ্রেফতার করা হয় জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক ও যুবলীগ নেতা এম গোলাম কিবরিয়া শামীমকে।

এই শামীমের বিষয়ে খালেদ জানিয়েছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে জি কে শামীমেরও সম্পর্ক ছিল। একপর্যায়ে জিসানের সঙ্গে তার ও সম্রাটের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। আর এর জন্য জি কে শামীম দায়ী। কারণ জি কে শামীম তার টেন্ডার কারবার নিয়ন্ত্রণে জিসানকে হাত করেন।

১০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব শামীমের:

গ্রেফতার এড়াতে র‌্যাব কর্মকর্তাদের ১০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন জি কে শামীম। র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার-বিন-কাশেম গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, জি কে শামীম তার অফিস ও বাসায় অভিযান না চালাতে এবং গ্রেফতার এড়াতে আমাকে ১০ কোটি টাকার ঘুষ প্রস্তাব করেছিলেন। প্রস্তাব আমলে না নিয়ে আমরা জি কে শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চালাই, তাকেসহ তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করি।

সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতেন শামীম:

কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতেন জি কে শামীম। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘুষ দিয়ে কাজ বাগানোর কথা স্বীকার করে জানান, ঠিকাদারির কাজ পেতে সাহায্য করার জন্য গণপূর্ত অধিদফতরের ২০ জন সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে মাসে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতেন। এছাড়া গণপূর্তের দুইজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন।

গোলাম কিবরিয়া শামীম প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বড় ১৭টি প্রকল্পের কাজ করছিলেন। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে সচিবালয়, সচিবালয় ক্যাবিনেট ভবন, র‌্যাব হেড কোয়ার্টার্স, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, বিজ্ঞান জাদুঘরের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here