সবুজদেশ ডেস্কঃ

সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে ভোট নিয়েছেন তারা। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ঘুষ, দুর্নীতি-অনিয়ম, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সম্পদ লুটপাটে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এমন বর্তমান ও সাবেক এক ডজন এমপিকে। এদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

অভিযুক্ত এমপিদের বিরুদ্ধে সরকারি-বেসরকারি জমি দখল, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে। রয়েছে বিদেশে অর্থ পাচার এবং টিআর, কাবিখাসহ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগ। দুদক এসব অভিযোগ ও তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছে। অনুসন্ধান পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দুদকের জালে আটকানো সরকারি দলের এমপিদের মধ্যে রয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (সুনামগঞ্জ-১), নজরুল ইসলাম বাবু (নারায়ণগঞ্জ-২), নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন (ভোলা-৩) এবং জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১২)।

বিএনপির যেসব সাবেক এমপি সম্পর্কে অনুসন্ধান করা হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন- রাজশাহী বিভাগীয় শাখার সহসাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মোমিন তালুকদার খোকা (বগুড়া-৩ আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া), কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু (লালমনিরহাট-৩ সদর), মো. শাহজাহান (নোয়াখালী-৪ সুবর্ণচর-সদর), এ কে এম এ আউয়াল (পিরোজপুর-১ সদর-নেছারাবাদ-নাজিরপুর) ও মো. শহিদুজ্জামান (ঝিনাইদহ-৪)। এ ছাড়া অনুসন্ধান করা হচ্ছে স্বতন্ত্র এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন (নরসিংদী-২ সদর একাংশ ও পলাশ) ও সাবেক স্বতন্ত্র এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লার (নরসিংদী-৩ শিবপুর) বিরুদ্ধে।

দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, বর্তমান ও সাবেক কতিপয় এমপির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে। অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আমলযোগ্য তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। ওই সব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে ওই সব বর্তমান ও সাবেক এমপিদের কয়েকজনের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। অনুসন্ধানে পাওয়া সম্পদ তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাদের আয়কর নথিতে উল্লেখ করা সম্পদ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

মোয়াজ্জেম হোসেন রতন :সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সরকারি ও এলাকার মানুষের সম্পত্তি লুটপাটের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুদকের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে বালু-পাথর উত্তোলন, কয়লা আমদানিকারক সমিতি, বিভিন্ন মার্কেট, বাজার, নানাজনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে রতনের বিরুদ্ধে। এভাবে অর্জিত অর্থসম্পদ রাখা হয়েছে স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতার নামেও।

দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, রতন এমপির নামে ঢাকা, সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জে ১৩টি বাড়ি রয়েছে। নিজের গ্রাম ধর্মপাশায় ১০ কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে সাত কোটি টাকায় ‘পায়েল পিউ’ বাড়ি কিনেছেন তিনি। ধর্মপাশা উপজেলা সদরেও তার আরও সাতটি বাড়ি রয়েছে। মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও রয়েছে দুটি বাড়ি। নেত্রকোনা জেলা শহরেও একটি বাড়ি রয়েছে। নেত্রকোনা শহরে মা-বাবার নামে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য তিনি প্রায় ৫০ কোটি টাকায় জমি কেনেন। ঢাকার গুলশানের নিকেতনে তার নামে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। সহোদর যতন মিয়ার নামে তিনি কিনেছেন পাঁচশ’ একর জমি।

নজরুল ইসলাম বাবু :এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে শিক্ষা, ভূমি অফিস, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজির মাধ্যমে নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। একাধিক মেয়াদে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন। দুদকে পেশ করা অভিযোগে বলা হয়, জমি ও ব্যাংকে জমানো টাকা তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন :এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধি হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক শাওন, তার স্ত্রী, বাবা, মা ও তার স্বার্থসংশ্নিষ্ট সবার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে।

সামশুল হক চৌধুরী :জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অভিযোগ- ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাড়ি, গাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ নানা সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। তার নামে বিভিন্ন ব্যাংকে মোটা অঙ্কের টাকা জমানো রয়েছে বলেও অভিযোগে বলা হয়।

আসাদুল হাবিব দুলু :সাবেক এমপি আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে লালমনিরহাট ও রংপুর অঞ্চলে টেন্ডারবাজি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।

রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু :বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে পাঁচশ’ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

মো. শাহজাহান :শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা গাড়ি বিক্রি করে দুই কোটি টাকার শুল্ক্ক ফাঁকি দেওয়া ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে বিএনপির সাবেক এমপি মো. শাহজাহানের বিরুদ্ধে। অভিযোগ- চারদলীয় জোট সরকারের সময় নির্বাচিত এই এমপি শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করে পরে সেটি বিক্রি করেন। এতে শুল্ক্ক বাবদ সরকারের দুই কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

এ কে এম এ আউয়াল :সাবেক এমপি এ কে এম এ আউয়ালের বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, অবৈধভাবে ফেরিঘাট থেকে ইজারা আদায়ের ও সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ রয়েছে।

কামরুল আশরাফ খান পোটন :সরকারের আমদানি করা সার গুদামে পৌঁছানোর বদলে খোলাবাজারে বিক্রি করে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে নরসিংদী-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটনের বিরুদ্ধে।

সরকারের আমদানি করা সার পরিবহনকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পোটন। এ সময় তিনি এক গুদাম থেকে সার নিয়ে অন্যখানে পৌঁছে না দিয়ে নিজের গুদামে মজুদ করেন। পরে সেগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করেন। গুদামজাত করা সার মৌসুমবুঝে চড়া দামে বিক্রিও করেছেন। ঢাকার গুলশান ও বনানীতে তার তিনটি বাড়ি, রাজধানীর পাশে কালিয়াকৈরে দুইশ’ বিঘা জমিতে বাগানবাড়ি, নরসিংদীতে নিজ গ্রামে ৩০০ বিঘা ধানিজমি ও বিলাসবহুল নিশান প্যাট্রোল গাড়ি রয়েছে তার। মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের মালিক ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার লিমিটেডের সভাপতি তিনি।

মো. শহিদুজ্জামান :সাবেক এমপি মো. শহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

সিরাজুল ইসলাম মোল্লা :শিবপুরের সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

আতিউর রহমান আতিক :জাতীয় সংসদের হুইপ শেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের এমপি আতিউর রহমান আতিকের বিরুদ্ধেও নানাভাবে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

আতিকের নামে রয়েছে শেরপুর শহরের মাধবপুরে ছয়তলা ভবনবাড়ি। সেটির পাশে রয়েছে আরও একটি তিনতলা ভবন। তিনি তাঁপর এলাকার কামারিয়া ও বাতশালা ইউনিয়নে নিজের নামে ১০-১২টি স্কুল, কলেজ ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আতিউর রহমান মডেল কলেজ, আতিউর রহমান মডেল গার্লস স্কুল, আতিউর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়, আতিউর রহমান আলিম মাদ্রাসা, আতিউর রহমান হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল, আতিক নগরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বসুন্ধরা ও বনশ্রীতে দুটি প্লট এবং ধানমন্ডি ও গুলশানে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার নামে। এ ছাড়া রয়েছে মেয়াদি আমানত, ব্যাংকে নগদ টাকা, গাড়িসহ নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here