গাজীপুরঃ

দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পর মৃত ঘোষণা করে ফিরিয়ে দেয়া হয় ফুরকান মিয়াকে (৫৫)। একটি নয় পরপর পাঁচটি হাসপাতালের চিকিৎসকগণ মৃত ঘোষণা করেন তাকে। কিন্তু বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পর লাশ নড়েচড়ে উঠে। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের কাছে তার পরের জীবনটা এখন বাড়তি পাওনা বলেই মনে করেন তারা। আর এ পাওনাটা তিনি দুর্ঘটনা কবলিত মানুষকে সাহায্য করে কাটিয়ে দিচ্ছেন।

যেখানেই দুর্ঘটনা কবলিত মানুষ চিকিৎসার জন্য পড়ে রয়েছেন সেখান থেকে তাৎক্ষণিক উঠিয়ে নিকটস্থ এমনকি প্রয়োজনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পঙ্গু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিশ্চিত মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনা থেকে ফিরে আসা ফুরকান বলেন, নিজের একটি প্রাইভেটকার ছিল। তা দিয়ে ভাড়ায় যাত্রী টেনে সংসার চালাতেন। ২০১১ সনের কোরবানির ঈদের সপ্তাহখানেক পর গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের হোতাপাড়া এলাকায় দুপুর আনুমানিক আড়াইটায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হন।

তিনি বলেন, যাত্রীরা রক্ষা পেলেও আমি মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হই। স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ (তৎসময়ে গাজীপুর সদর হাসপাতাল) হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার স্বজনরা খবর পেয়ে হাসপাতালে চলে আসেন। হাসপাতাল থেকে আমাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের সদস্যরা ফুরকানকে নিয়ে যান উত্তরা ও ঢাকাসহ আরও চারটি প্রাইভেট হাসপাতালে। সেসব হাসপাতাল থেকেও তাকে মৃত ঘোষণা করে ফিরিয়ে দেন।

ফুরকানের পরিবারের সদস্যরা জানান, হাসপাতাল থেকে মৃত ঘোষণা করায় ওই রাত সাড়ে ৩টার দিকে নিজ বাসায় ফেরেন। বাসায় ফেরার একঘণ্টা পর ফুরকান মিয়ার জ্ঞান ফিরে আসে। পরে আবার তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সুস্থ হয়ে উঠেন ফুরকান মিয়া।

ফুরকান মিয়া জানান, ২০১১ সনের ২১ নভেম্বর অনেকটা সুস্থ হয়ে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করেন। দরিদ্র, অসহায়, প্রতিবন্ধী রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিনামূল্যে পরিবহন সেবা প্রদান শুরু করেন। ২০১৪ সনে তার এক চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চার লাখ টাকায় একটি অটোরিকশা ক্রয় করেন।

তিনি জানান, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৮৯ জন রোগীকে চিকিৎসার জন্য তিনি বিনামূল্যে পরিবহন সেবা প্রদান করেছেন। সেবা প্রদান করা রোগীদের জন্য তিনি একটি রেজিস্ট্রার খাতা ব্যবহার করেন। অটোরিকশার জ্বালানি খরচ নিজের পকেট থেকেই দিয়ে থাকেন। তবে দুর্ঘটনাকবলিত কেউ নিজে দিতে চাইলে তা ফিরিয়ে দেন না। কিন্তু দুর্ঘটনাকবলিত আহত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন সেবা দিয়ে থাকেন।

তার অটোরিকশার ভেতরে অ্যাম্বুলেন্সের আদলে সাংকেতিক লাইট, চলমান অবস্থায় সতর্কতামূলক শব্দ যন্ত্র, গরিব ও অসহায় রোগীদের সাহায্যার্থে একটি দানবাক্স যুক্ত রয়েছে। অটোরিকশার চারপাশে লেখা রয়েছে চিকিৎসার জন্য গরিব, অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ফ্রি।

ফুরকান মিয়া জানান, রোগী পরিবহনে বিভিন্ন সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের নানামুখী প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। তার অটোরিকশার লাইসেন্সটি গাজীপুর থেকে নিবন্ধিত হওয়ায় তাকে বেশ কয়েকবার এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে। কখনও কখনও তার অটোরিকশা ট্রাফিক পুলিশ দুই বা তিনদিন আটক করে রেখেছেন। পরে তার ইতিহাস ও কাগজপত্র দেখানোর পর পুলিশের কাছ থেকে অটোরিকশা ছাড়াতে সক্ষম হন। বিশেষ করে হাসপাতালে রোগী রেখে ফেরার পথে এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

সেবা নেয়া গাজীপুর মহানগরের কুনিয়া বড়বাড়ী এলাকার দরিদ্র ও শারীরিক প্রতিবন্ধী জাকির হোসেন (৪৫) বলেন, গত চার বছর যাবত বিনা ভাড়ায় ফুরকান মিয়ার পরিবহন সেবা গ্রহণ করছেন। চার বছরে সাভার সিআরপি ও ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে যাতায়াতে ফুরকান মিয়া তার কাছ থেকে কোনো ভাড়া নেয়নি।

কুনিয়া চৌধুরী মার্কেট এলাকার মুন্নী আক্তার বলেন, বছর তিনেক আগে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এক বছরের মতো ভুগছিলেন। বিনা ভাড়ায় ফুরকান মিয়া তাকে হাসপাতালে যাতায়াত করিয়েছেন।

একই এলাকার আবদুল জলিল বলেন, ফুরকান মিয়ার বিনামূল্যে পরিবহন সেবা আমিও গ্রহণ করেছি। তিনি দুর্ঘটনাকবলিত মানুষকে কেবল দুর্ঘটনার সময়ই সেবা দেন এরকম নয়। পরবর্তী চিকিৎসা সেবার জন্য কেউ চাইলে তখনও তিনি সেবা দিয়ে থাকেন। যাদের বিনিময়মূল্য দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে থাকেন। কিন্তু যাদের নেই তাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক তিনি নেন না।

ফুরকান মিয়ার স্ত্রী জেসমিন আক্তার বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর আল্লাহ তার স্বামীর জীবন রহমত হিসেবে তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে তিনি দুর্ঘটনাকবলিত মানুষকে তার অটোরিকশা দিয়ে তাৎক্ষণিক পরিবহন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

গাজীপুর মহানগরের বোর্ড বাজার গাছা রোড ফকির মার্কেট এলাকায় ফুরকান মিয়ার বসবাস। দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে জাহিদুল হাসান স্নাতক ও ছোট ছেলে সাজ্জাদ হোসাইন নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here