খুলনাঃ
স্ত্রী ও শিশু সন্তান হত্যার মিথ্যা অভিযোগে দীর্ঘ ২০টি বছর কেটেছে কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকারে। দেখা হয়নি মুক্ত আকাশ। ছোঁয়া লাগেনি মিষ্টি রোদ, প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়া হয়নি খোলা হাওয়ায়। হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুদণ্ডও। তবে ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে! তাই শেষ বিদায়ের ঘোষণা হওয়া অবস্থায়ও এক আদালতের রায় বাতিল করেছেন আরেক উচ্চ আদালত। সেই বিচারেই অবশেষে কারাভ্যন্তরের সেই কনডেম সেল থেকে মুক্ত পৃথিবীর আলোর দেখা পেলেন খুলনার আলোচিত কয়েদি শেখ জাহিদ (৫০)।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে শেখ জাহিদ খুলনা জেলা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। এ সময় তার স্বজনরা তাকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে, বিনা দোষে জীবনের মূল্যবান ২০টি বছর নষ্ট হয়ে গেলেও শেখ জাহিদ এজন্য এখন আর কাউকে দায়ী করছেন না বা কারও শাস্তি চান না।বাকি জীবন আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করেই পার করতে চান। এর আগে সোমবার দুপুরে শেখ জাহিদের মুক্তির নির্দেশনা বাগেরহাট আদালত থেকে খুলনা জেলা কারাগারে এসে পৌঁছালে তার মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। আদালতের নির্দেশনা হাতে পাওয়ার পরই সন্ধ্যায় শেখ জাহিদকে মুক্তি দেয়া হয়।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার মো. ওমর ফারুক বলেন, স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশুকন্যাকে হত্যার দায়ে ২০০০ সালের ২৫শে জুন মৃত্যুদণ্ড হয় যুবক জাহিদ শেখের। তারপর থেকেই তিনি কারাগারের কনডেম সেলে টানা ২০ বছর ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কিন্তু মামলা প্রমাণিত না হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শেখ জাহিদকে ২৫শে আগস্ট খালাসের রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বাগেরহাট আদালতে তার খালাসের নির্দেশ পাঠানো হয়। সেখান থেকে ওই নির্দেশনা সোমবার খুলনা কারাগারে এসে পৌঁছানোর পরই তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
এদিকে, দীর্ঘ ২০ বছর পর শেখ জাহিদের মুক্তির খবরে তার স্বজনরা আগে থেকেই জেলা কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তার চাচা শেখ আশরাফুজ্জামান, ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান ও আব্দুস সালাম এবং তার ছোট বোন।
মুক্তির পর শেখ জাহিদ বলেন, ফাঁসির কনডেম সেলে ‘প্রতি মুহূর্তেই তিনি মৃত্যু কামনা করতেন। ভাবতেই পারেননি কোনো দিন মুক্তি পাবেন।’ তার মুক্তির জন্য তিনি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এবং কারা কর্তৃপক্ষ যারা তার মুক্তির জন্য সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মুক্তির পর তাকে খুলনা মহানগরীর মিয়াপাড়া এলাকায় তার বোনের বাসায় নেয়া হয়।
কারাফটকে জাহিদের ভগ্নিপতি আজিজুর রহমান জানান, প্রথমে জাহিদের নামে নারী নির্যাতন আইনে ফকিরহাট থানায় মামলা দায়ের হলে মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা জাহিদের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করেন এবং সেই টাকা দিতে না পারায় জাহিদকে ওই মামলায় একতরফা দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিট প্রদান করা হয়। ২০টি বছর নষ্ট হওয়ায় জাহিদ যাতে বাকি জীবন কিছু করে খেতে পারে- তার ব্যবস্থা করতে তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান।
এদিকে দীর্ঘ ২০ বছর পর বেকসুর খালাস পাওয়া জাহিদ শেখের চাচা আকরাম হোসেন শেখ আক্ষেপ করে বলেন, জাহিদের ২০ বছরের জীবন ফেরত দেবে কে? কে দেবে তার জবাব? মাতৃহীন পিতৃহীন ও সম্বলহীন জাহিদের দায়িত্ব নেবে কে?
তিনি জানান, জাহিদ জেলে থাকা অবস্থায় তার বাবা ইলিয়াছ শেখ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এবং মাতা হামিদা বেগম বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক যারা জাহিদের জীবন নষ্ট করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার উত্তরপাড়ার ময়েন উদ্দিনের মেয়ে রহিমার সঙ্গে খুলনার রূপসা উপজেলার নারিকেলি চাঁদপুরের ইলিয়াছ শেখের ছেলে জাহিদ শেখের বিয়ে হয়। জাহিদ শেখ শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই থাকতেন। পরে তাদের সংসারে কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় রেশমা খাতুন। ১৯৯৭ সালের ১৫ই জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের তিন মাস আগে রহিমার বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি পাকা ঘরে বসবাস শুরু করে ওই দম্পতি। ১৬ই জানুয়ারি বিকালে রহিমার মা আনজিরা বেগম মেয়ের বাড়ির দরজা ভেজানো অবস্থায় দেখতে পান। বাইরে থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর কাঁথা ও লেপের নিচে বাচ্চাসহ রহিমার লাশ পান তিনি। ওই ঘটনায় রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন বাদী হয়ে পরদিন ফকিরহাট থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ১৯শে নভেম্বর অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগেই ওই বছরের ১৮ই জানুয়ারি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন জাহিদ।
হত্যাকাণ্ডের তিন বছরের মাথায় ২০০০ সালের ২৫শে জুন বাগেরহাটের জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামি শেখ জাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২রা সেপ্টেম্বর জেল আপিল করেন তিনি। সে হিসেবে আসামি জাহিদ শেখ ২০ বছর ধরে কনডেম সেলে ছিলেন। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও জেল আপিলের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৩১শে জুলাই তার ফাঁসির রায় বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ওই বছর ২৯শে ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন আসামি জাহিদ শেখ। গত ২৫শে আগস্ট সে আপিলের শুনানি শেষে রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।