সবুজদেশ ডেস্কঃ

‘জন্মিলে মরিতে হইবে’ এই অমোঘ সত্য কে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তবে অন্যান্য যে কোনো বছরের তুলনায় এ বছরে মানুষ বেশি সংখ্যক প্রিয়জন আর গুণীজন হারিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২০ এর শুরু থেকে ক্রমেই দীর্ঘায়িত হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। এ বছর করোনা এবং অসুস্থতাজনিত কারণে চলচিত্র, সংগীত ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। এসব প্রিয় মুখগুলোর শূণ্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়।

মতিউর রহমান পানু
বেদের মেয়ে জোছনাখ্যাত প্রযোজক ও পরিচালক মতিউর রহমান পানু মারা যান এবছরের প্রথমদিকে। ১৯৭৯ সালে তিনি হারানো মানিক ছবিটি পরিচালনা করে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায় রিয়াজ-পূর্ণিমা জুটিকে নিয়ে নির্মাণ করেন বহুল আলোচিত ও ব্যবসা সফল ছবি মনের মাঝে তুমি| আপন ভাই, নাগ মহল, নির্দোষ, সাহস, মান মর্যাদা, নির্যাতন ও সাথী এসব সিনেমা তিনি নির্মাণ করেন এবং প্রযোজনা করেন মোল্লা বাড়ির বউ, ডাক্তার বাড়ী আর ওরে সাম্পানওয়ালা। ২৪ মার্চ মঙ্গলবার রাতে উত্তরার নিজ বাসায় মতিউর রহমান পানু ইন্তেকাল করেন। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।

এন্ড্রু কিশোর
আটবার চলচিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর ৬ জুলাই রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ খ্যাত  এই বরেণ্য শিল্পী দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ১৯৭৭ সালে এন্ড্রু কিশোর আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘পদ্মপাতার পানি’, ‘ও গো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙ্গাল’ ইত্যাদি।

কে এস ফিরোজ

ছোটপর্দার পরিচিত মুখ অভিনেতা কে এস ফিরোজ মারা গেছেন ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টা ২০ মিনিটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও করোনা উপসর্গ ছিল তার। ১৯৪৪ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন এ অভিনেতা। ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনীর মেজর পদে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। নাট্যদল ‘থিয়েটার’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিনয়ে কে এস ফিরোজের পথচলা শুরু। প্রথম অভিনয় করেন ‘দীপ তবুও জ্বলে’ নাটকে। ছোটপর্দার পাশাপাশি বড়পর্দাতেও ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

সাদেক বাচ্চু
১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন নন্দিত অভিনেতা  সাদেক বাচ্চু। তিনি মূলত চলচ্চিত্রের খল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।৬৬ বছর বয়সী এ অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ২০১৩ সালে তার হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিলো। সর্বশেষ ৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। করোনা উপসর্গ থাকায় চিকিৎসকদের পরামর্শে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষায় কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে। অবশেষে করোনায় প্রাণ যায় এই জনপ্রিয় অভিনেতার।

আলী যাকের
নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ আর টেলিভিশনে দাপুটে অভিনয়ের জন্য দর্শক হৃদয়ে স্থায়ী আসন নিয়ে আছেন আলী যাকের।ক্যান্সারের সঙ্গে চার বছরের লড়াই শেষে এ বছর  চির বিদায় নিলেন অভিনেতা, নির্দেশক আলী যাকের। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ নভেম্বর ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয় বলে তার বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আলী যাকেরের ছেলে ইরেশ যাকের ফেইসবুকে এক পোস্টে জানিয়েছেন, মৃত্যুর দুদিন আগে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও ধরা পড়েছিল তার বাবার। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই নাট্যজনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বিশিষ্টজনেরা।

আবদুল কাদের
১৯৯৩-১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে ‘বদি’ চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান আব্দুল কাদের। এছাড়া দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি । শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আব্দুল কাদের। গত ৮ ডিসেম্বর চেন্নাইতে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় তাকে। সেখানকার হাসপাতালে পরীক্ষার পর ১৫ ডিসেম্বর তার ক্যানসার ধরা পড়ে। শারীরিক দুর্বলতার কারণে কেমোথেরাপি না দিয়েই আব্দুল কাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেন তার পরিবার। জনপ্রিয় এই অভিনেতা একইসঙ্গে টিভি নাটক, বিজ্ঞাপনচিত্র ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দেশের অন্যতম পরিচিত মঞ্চ নাটকের দল ‘থিয়েটার’র সদস্য হয়ে দলটির ৩০টি প্রযোজনায় অভিনয় করেছেন তিনি। যেগুলোর মধ্যে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়; তোমরাই; স্পর্ধা; মেরাজ ফকিরের মা;  দুই বোন এবং এখনো ক্রীতদাস উল্লেখযোগ্য।

১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৭৩ সাল থেকে রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু করেছিলেন তিনি। টেলিভিশনে তার অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এসো গল্পের দেশে’। তিনি দুই হাজারের বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক— কোথাও কেউ নেই; মাটির কোলে; নক্ষত্রের রাত; শীর্ষবিন্দু; সবুজ সাথী; তিন টেক্কা; যুবরাজ; আগুন লাগা সন্ধ্যা; প্যাকেজ সংবাদ; সবুজ ছায়া; কুসুম কুসুম ভালোবাসা; নীতু তোমাকে ভালোবাসি; আমাদের ছোট নদী; দুলাভাই; অজ্ঞান পার্টি; মোবারকের ঈদ; বহুরূপী; এই মেকআপ; ঢুলিবাড়ি; সাত গোয়েন্দা; এক জনমে; জল পড়ে পাতা নড়ে এবং খান বাহাদুরের তিন ছেলে ইত্যাদি। ‘রং নাম্বার’ নামের একটি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন আবদুল কাদের।

একটি উত্তর ত্যাগ

Please enter your comment!
Please enter your name here